জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ তথা কথিত কোন রাজনৈতিক দল নয়। এই দলের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। তার নিকটতম একটি উপমা হলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। চলুন মূল আলোচনায় আসি।
somadanmedia.com |
১৯৬৮ সালের ৮ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় তৎকালীন জমিয়তের সেক্রেটারী জেনারেল মুফতি মাহমুদ রাহ. জামহুরি মজলিস-ই- আমালের প্রধান নেতা ছিলেন; যিনি আইয়ুব খানের শাসনের বিরোধিতা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুফতি মাহমুদ রাহ. পশ্চিম পাকিস্তানের ডেরা ইসমাইল খান নির্বাচনী আসনে জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
অল-পাকিস্তান জমিয়ত সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ রাহ. ১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে স্পষ্ট ভাষায় ইয়াহিয়া-ভূট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো প্রেসিডেন্টের অবশ্যই কর্তব্য। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম কোন জাতীয় নেতা- যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনের প্রতি সবাত্মক সমর্থন প্রদান করেছেন।
১৯৭১ সালের ১৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন দমনের জন্য পশ্চিমা শাসকমহল যে আদেশ জারি করেছিল, তার মোকাবিলায় বিরোধী দলীয় নেতা জমিয়ত সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ রাহ. এর সভাপতিত্বে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সভায় সামরিক আইন প্রত্যাহার, ২৫ মার্চের আগেই ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
একাত্তরের যুদ্ধের শুরুতেই ২৩ মার্চ পাকিস্তানী শাসকদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তানে এসে শেখ মুজিবুর রহমান-এর সাথে একাধিক বৈঠক করেন অল পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ রাহ.। প্রথম বৈঠক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে উভয় নেতা আরো বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে জমিয়ত সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাহমুদ পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের দাবীকে জোরালোভাবে সমর্থন করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলেন।
মুফতি মাহমুদ রাহ, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে ৩টি মূল্যবান নির্দেশনা
১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের শীর্ষ নেতা এবং পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ'র সভাপতি মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী রাহ. বলেন, "১৯৭১ সালের ১৬ থেকে ২৪ মার্চের মধ্যে ইয়াহইয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দফায় দফায় বৈঠক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হলে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে যাওয়ার সময় মুফতি মাহমুদ রাহ, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে ৩টি মূল্যবান নির্দেশনা ও মতামত দিয়ে যান। সেখানে আমি ও ছিলাম। তিনি পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন-
(১) পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা এই দেশকে আর ধরে রাখতে পারবে না। আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের জমিয়ত নেতা-কর্মী যারা আছেন, তারা এখন থেকেই এই অঞ্চলের স্বাধীনতার পক্ষে প্রত্যক্ষভাবে কাজ শুরু করুন। পাশাপাশি দেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে শামিল হতে উৎসাহিত করুন। আমরা যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানে থাকব, আমরা পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করব। কিন্তু আপনারা সর্বাত্মকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করে যাবেন। এই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে।
(২) আপনারা এমন কোন দলের সাথে মিলে কোন কাজ করবেন না যাদের দ্বারা আপনারা প্রভাবিত হন। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে যে কোন দলের সাথে মিলে কাজ করতে পারব। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানে অন্যান্য দলের তুলনায় জমিয়তের প্রভাব বেশি। সুতরাং আপনারা নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে কাজ করতে সচেষ্ট থাকবেন।
(৩) আমি স্পষ্টত: বুঝতে পারছি একই দেশের নাগরিক হিসেবে এটাই আমার শেষ সফর। আগামীতে পূর্ব পাকিস্তানে আসতে হলে ভিসা নিয়েই আসতে হবে। ভিসা ছাড়া আর আসা যাবে না।
জমিয়ত শীর্ষনেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহ. এক সাক্ষাৎকার।
মাসিক মদীনার সম্পাদক জমিয়ত শীর্ষনেতা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রাহ. এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকের পর মুফতি মাহমুদ রাহ. র সাথে বৈঠক করে সম্ভাব্য যুদ্ধোন্মুখ পরিবেশে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের ভূমিকা কেমন হবে? এ বিষয়ে জানতে চাইলাম। তিনি তখন জমিয়তের নেতা-কর্মিদেরকে বললেন, আপনারা পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পক্ষ অবলম্বন করেন। আপনাদের এখানেই থাকতে হবে। তাই আপনারা এই অঞ্চলের স্বাধীকারের পক্ষেই কাজ করে যাবেন।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে সর্বাত্মক সমর্থন, বিবৃতি, বক্তব্য ও মিছিল-সমাবেশ করে ভারতের জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারে বিশ্ববাসী এবং ভারতীয় মুসলমানরা যাতে বিভ্রান্ত না হয়, সে জন্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নেতৃবৃন্দ আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী, হায়দার আবাদ প্রদেশে বিভিন্ন সভা-সেমিনার, কনভেনশন আয়োজন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। সীমান্ত অঞ্চলে মাওলানা আসআদ মাদানী রাহ. এর নেতৃত্বে বহু ক্যাম্প স্থাপন করে শরণার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ তখন স্পষ্টভাবে ঘোষণা দেয়- পাকিস্তান সরকার ইসলামের নামে বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর যে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে, পবিত্র ইসলাম ধর্ম এরূপ বর্বরতাকে সমর্থন করে না।
সূত্র: পরিচিতি ও কর্মসূচি। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।