সাহাবাদের মেহমানদারির বে'নযীর দৃষ্টান্ত যা অন্তরকে বিগলিত করবে!

 একদিন নবী করীম (সা) এর নিকট একজন লোক এসে বললোঃ 'আমার ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে আমাকে কিছু খেতে দিন। আল্লাহ আপনাকে বরকত দেবেন।'

সাহাবাদের মেহমানদারির বে'নযীর দৃষ্টান্ত যা অন্তরকে বিগলিত করবে!
somadanmedia.com

হজুর (সা) বাড়ীর ভেতর সংবাদ পাঠালেন কিছু খাদ্য প্রেরণের জন্য। কিন্তু প্রত্যেক স্ত্রী উত্তর পাঠালেনঃ 'শপথ সেই সত্তার, যিনি আপনাকে সত্য সহকারে পাঠিয়েছেন। আমার নিকট পানি ছাড়া আর কিছুই নেই।'

তখন নবী করীম (সা) বললেন: 'তোমাদের মধ্যে আজ কে এ লোকের মেহমানদারী করবে?'

এক আনসার সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন: 'ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি এর মেহমানদারী করবো।' তখন তিনি মেহমানকে নিয়ে নিজের বাড়ীতে গেলেন এবং স্ত্রীকে বললেন: 'তোমার কাছে কোন খাবার আছে কি', নবী করীম (সা) এর পাঠানো এ মেহমানের জন্য?'

স্ত্রী জবাব দিলেন: 'বাচ্চাদের খাবার পরিমাণ খাদ্য ছাড়া আর কিছুই নেই।'

আনসারী বললেন: 'ঠিক আছে, তুমি বাচ্চাদের কিছু একটা দিয়ে ভুলিয়ে রাখো। রাতে খাবার চাইলে ঘুম পাড়িয়ে দিও। আর আমাদের মেহমান যখন

খেতে আসবে তখন বাতি নিভিয়ে দেবে এবং এমন শব্দ করতে থাকবে যেন মেহমান বুঝতে পারে আমরাও তার সাথে খাচ্ছি।'

কথানুযায়ী তারা সবাই মিলে খেতে বসলেন। বাতি নিভিয়ে মেহমানকে তাঁরা খানা খাওয়ালেন এবং নিজেরা সারা রাত উপোস করে কাটিয়ে দিলেন। পরদিন সকালে যখন ঐ সাহাবী নবী করীম (সা) এর নিকট এলেন।

তখন হুজুর (সা) তাকে বললেন: 'তোমরা গতরাতে মেহমানের সাথে যে আচরণ করেছো এতে স্বয়ং আল্লাহ তোমাদের প্রতি সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।'

সূত্র: সহীহ আল বুখারী ও সহীহ আল মুসলিম। হযরত আবু হুরাইরা (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস অবলম্বনে।

শিক্ষাঃ

 যে ব্যক্তি নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বে ও অপরকে অগ্রাধিকার দেন আল্লাহ তাকে মাফ করে দেন এবং তার উপর সন্তুষ্ট হন।

জাবির (রা) এর মেহমানদারী

মক্কার কাফের মুশরিক বদরে ও উহুদে পরপর দু'বার মুসলমানদের হাতে শোচনীয় মার খাবার পর মরন কামড় দেয়ার জন্য পাগল হয়ে উঠলো। তারা মক্কা ও তার আশ-পাশের সমস্ত কাফের মুশরিক শক্তিকে একত্রিত করার চেষ্টায় লিপ্ত হলো। এমন কি মদীনার আশ-পাশের ইহুদী গোত্রগুলোকেও তাদের পক্ষে নেবার ষড়যন্ত্র শুরু করলো। উদ্দেশ্য এবার আর কোন ময়দানে নয়, সম্মিলিত শক্তিনিয়ে সরাসরি মদীনার উপর চড়াও হবে এবং মুসলমানদেরকে চির দিনের জন্য নিশ্চিহ্ন করে দেবে। যেন তাদের পূর্ব পুরুষের ধর্মের সাথে মুসলমানগণ আর কোন দিন বাড়া বাড়ি করতে না পারে।

নবী করীম (সা) ও তাঁর অভিজ্ঞ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে যথা সময়ে তাদের এ দুরভিসন্ধি জানতে পারলেন। তখন তিনি মজলিসে শুরার সাথে পরামর্শ করতে লাগলেন কিভাবে কাফেরদের বিশ দাঁত ভেঙ্গে দেয়া যায়। এমন সময় হযরত সালমান ফারসী (রা) দাঁড়িয়ে বিনয়ের সাথে হুজুর (সা) এর অনুমতি নিলেন। পরামর্শ দেয়ার জন্য অনুমতি পেয়ে মদীনার চতুর্দিকে পরিখা খনন করে তাদের মুকাবেলা করার পরামর্শ দেন। ইতি পূর্বে মক্কা ও

মদীনাবাসী এ ধরনের যুদ্ধের সাথে পরিচিত ছিলো না। পরামর্শটি নবী করীম (সা) সহ সাহাবীদের মনোপূত হলো। মদীনার সমস্ত সক্ষম জন শক্তিকে পরিখা খননের কাজে নিয়োজিত করলেন। তারা ঘর-সংসার, ব্যবসা-বাণিজ্য এমন কি সময় মতো খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত বাদ দিয়ে সারাক্ষণ একাজে নিয়োজিত রইলেন।

এক দিনের ঘটনা: মদীনার বিত্তহীন এক সাহাবী হযরত জাবির (রা) দেখতে পান রাসূলে আকরাম (সা) মাটি কাটতে কাটতে পরিশ্রম এবং ক্ষুধার তাড়নায় কুঁজো হয়ে গিয়েছেন। হুজুর (সা) এর নিকট হতে কিছুক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলেন। এসে স্ত্রীকে বললেন: 'তোমার কাছে কিছু খাবার আছে কি? আমি রাসুল (সা)কে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত দেখে এসেছি।' স্ত্রী অনেক খোঁজাখুঁজির পর একসা' পরিমাণ যব পেলো। তিনি তা পিষে নিলেন। জাবির (রা) এর একটি ছাগল ছানা ছিলো, তা তিনি যবেহ করে গোল্ড বানিয়ে উনুনে চড়িয়ে দিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট ফিরে যেতে উদ্যত হলে স্ত্রী বললেন: 'দেখো আমাদের আয়োজন খুবই সামান্য, আমাকে রাসূল (সা) ও তার সহচরদের সামনে লজ্জিত করো না।'

তখন জাবির (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট গিয়ে ঘটনা বললেন এবং অল্প কিছু সাহাবীসহ জাবির (রা) এর বাসায় খেতে অনুরোধ করলেন। দাওয়াত পেয়ে রাসূল (সা) চীৎকার করে সমস্ত লোককে দাওয়াত দিয়ে দিলেন এবং তাড়াতাড়ি দাওয়াতে অংশ গ্রহণের জন্য তাড়া দিলেন। ঘটনা দেখে জাবির (রা) থ খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ব্যাপারটি বুঝতে পেরে নবী করীম (সা) বলে দিলেন, যাও, আমি না আসা পর্যন্ত উনুন থেকে হাঁড়ি নামিও না এবং আটা দিয়ে রুটিও তৈরী করো না।

জাবির (রা) বাড়ী এসে সব কিছু স্ত্রীকে বলে রাসূল (সা) এর প্রতীক্ষায় বসে রইলেন। একটু পর রাসূল (সা) এসে আটার মধ্যে এবং গোল্ডের হাঁড়ির মধ্যে থু-থু দিয়ে আল্লাহর নিকট বরকতের জন্য দোয়া করলেন। তারপর তাকে বললেন: জাবির আরেক জন মহিলাকে ডেকে আনো রুটি তৈরীর জন্য এবং তুমি হাঁড়ির নিকট বসে গোশত বণ্টন করতে থাকো। খবরদার! উনুন থেকে হাঁড়ি নামিও না।'

 এভাবে মোট এক হাজার লোক তৃপ্তি সহকারে খেয়ে স্বস্থানে ফিরে যাবার পরও তাঁর হাঁড়ির গোশত ও আটা পূর্বাবস্থায়ই রইলো। (১) এক সা' প্রায়-৩সের ১১ ছটাকের সমান।

সূত্র: সহীহ আল বুখারী ও সহীহ আল মুসলিমে হযরত জাবির (রা) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস অবলম্বনে।

শিক্ষা:

 উপরোক্ত ঘটনায় নবী করীম (সা) এর বিরাট এক মো'জিযা'র প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি খাদ্য যত কমই হোক না কেন সাহাবীদেরকে ছেড়ে তা খাওয়া পছন্দ করতেন না। নিয়ত সহীহ থাকলে তাতে আল্লাহ বরকত দান করেন।

আবু বকর (রা) এর মেহমানদারী

কিছু সাহাবী ঘর সংসার, ব্যবসা বাণিজ্য সবকিছু বাদ দিয়ে সারাক্ষণ মসজিদে নববীতে পড়ে থাকতেন। নবী করীম (সা) এর নিকট দ্বীনি প্রশিক্ষণ নিতেন। তাদেরকে বলা হতো আসহাবে সুফ্ফা। প্রায়ই কোথাও না কোথা হতে নবী করীম (সা) এর নিকট উপহার উপঢৌকন আসতো। সেগুলো তিনি আসহাবে সুফফাদের মাঝে বন্টন করে দিতেন। তা খেয়েই কোন মতে তারা জীবন ধারণ করতো।

একদিন নবী করীম (সা) বললেন: 'যার নিকট দু'জনের খাবার আছে সে যেনো তৃতীয় আরেকজন সাথে করে নিয়ে যায়। আর যার কাছে চার জনের খাবার আছে সে যেনো পঞ্চম ও ষষ্ঠ জনকে নিয়ে যায়। 'এ ঘোষণা শোনে সামর্থ্যবান সবাই দু'একজন করে আহলে সুফফাকে নিয়ে যার যার বাড়ীতে গেলেন। আবুবকর (রা) তিনজনকে সাথে নিয়ে বাড়ীতে গেলেন। ছেলে আব্দুর রহমান (রা) কে বললেনঃ তুমি এ মেহমানদের দেখা শুনা করো। আমি একটু নবী করীম (সা) এর নিকট যাবো। আমি আসার পূর্বেই তুমি এদের মেহমানদারী শেষ করে ফেলো।'

আব্দুর রহমান (রা) ভেতরে চলে গেলেন। বাড়ীতে যা কিছু ছিলো তা মেহমানদের সামনে হাজির করলেন। তারপর বললেন: 'আপনারা মেহেরবানী করে খেয়ে নিন।'

মেহমানগণ বললেনঃ 'তোমার আব্বা কোথায়? আমরা তাকে ছাড়া খাবো না।'

আব্দুর রহমান (রা) বললেনঃ 'আব্বা যদি এসে দেখেন যে, আপনারা খানা খাননি, তাহলে আমাদেরকে ঝামেলা পোহাতে হবে। কাজেই আপনারা খেয়ে নিন।'

মেহমানগণঃ 'না, আমরা কিছুতেই তাকে ছাড়া খানা খাবো না।' আব্দুর রহমান (রা) প্রমাদ গুনলেন। কারণ এ অবস্থায় যদি আবু বকর (রা) ফিরে এসে দেখেন যে মেহমানগণ খাননি তাহলে তিনি রেগে যাবেন। ইত্যবসরে হযরত আবু বকর (রা) বাড়ীতে ফিরে এলেন।

স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেনঃ 'মেহমানদের ছেড়ে আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?' আবুবকর (রা): 'কেন? মেহমানদেরকে খানা খাওয়াও নি?' স্ত্রী বললেনঃ 'তাদের সামনে খানা পেশ করা হয়েছিলো, কিন্তু তারা জানিয়ে দিয়েছেন যে, আপনাকে ছাড়া খাবেন না।'

এদিকে আবু বকর (রা) এর কণ্ঠস্বর শোনামাত্র আব্দুর রহমান (রা) ভয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনে তিনি উচ্চস্বরে বললেন: সে নির্বোধটা কোথায়? আমি তোকে কসম দিয়ে বলছি, ডাক শোনলে চলে আয়।'

আব্দুর রহমান (রা) আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন এবং বললেন: 'মেহমানদেরকে জিজ্ঞেস করুন।'

মেহমানগণ একযোগে সবাই তাঁর কথার সত্যতার প্রমাণ দিলেন। অতপর তিনি মেহমানদেরকে বললেন: 'আপনারা খেয়ে নিন। আল্লাহর কসম। আমি আজ রাতে কিছুই খাবো না।'

মেহমানগণও উল্টো কসম করে বললেন: 'আপনি না খেলে আমরাও খাবো না।'

যাহোক বহু পীড়াপীড়ির পর সবাই মিলে খাবার খেতে বসেগেলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রতি গ্রাস তুলতে না তুলতেই সেখানে আগের চেয়ে বেশী খাবার জমা হয়ে যেতো। এদৃশ্য দেখে আবুবকর (রা) স্ত্রীকে লক্ষ্য করে বললেন: 'হে বনী ফিরাসের বোন, একি!'

স্ত্রী বললেন: 'হে প্রিয়তম! এতো দেখছি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে গেছে।'

তারা সবাই মিলে পূর্ণতৃপ্তি সহকারে খেলেন এবং অবশিষ্ট খানা নবী করীম (সা) এর দরবারে পাঠিয়ে দিলেন।

সূত্র: সহীহ আল বুখারী ও সহীহ আল মুসলিমের বিভিন্ন বর্ণনা অবলম্বনে।

শিক্ষা: 

নিজের প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও আরেক ভাইয়ের প্রয়োজন পূর্ণ করার প্রচেষ্টাই ইসলামের আদর্শ।

About the author

Somadanmedia
A trusted platform of Education-Culture & News and Islamic Matters And online trip's

Post a Comment