মসজিদে আকসার তাৎপর্য ও ফজীলত

 পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীসে মসজিদুল আকসার তাৎপর্য ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। সেই ফজিলত এবং তাৎপর্যগুলো আমাদের জানা দরকার। আজকের এ আর্টিকেলটি তাদের জন্য যারা মসজিদুল আকসার ফজিলত ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাহলে চলুন আলোচনা শুরু করা যাক।

মসজিদে আকসার তাৎপর্য ও ফজীলত

 মসজিদে আকসার নাম সমূহ:

 মসজিদে আকসার মোট ৭টি নাম রয়েছে। ১টি হচ্ছে, মসজিদে আকসা। 'আকসা' শব্দের অর্থ হচ্ছে 'দূরবর্তী'। মসজিদে আকসার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, দূরবর্তী মসজিদ। মক্কার মসজিদে হারাম থেকে মে'রাজের সূচনা হয়। সেই উপলক্ষে, কুরআনের সূরা ইসরায় 'মসজিদে আকসা" শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হয়। সম্ভবতঃ মক্কা থেকে এটি দূরে বলে আল্লাহ ঐ মসজিদকে 'দূরবর্তী মসজিদ' বা মসজিদে আকসা বলে অভিহিত করেন। আগে এর নাম ছিল, বাইতুল মাকদিস। কিন্তু রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ইসলামী যুগ থেকে ঐ মসজিদের নামকরণ করা হয় 'মসজিদে আকসা'। এর অন্য নামগুলো হচ্ছে, ৩ আল- কুদস ৪. মসজিদে ইলিয়া ৫. সালাম ৬. উরুশলেম ও ৭. ইয়াবুস। উলামায়ে কেরাম ও ঐতিহাসিকদের মতে, মে'রাজের সময় মসজিদে আকসার কোন ঘর ছিল না। বরং পরবর্তীতে সেখানে মসজিদে আকসা ও মসজিদে সাখরার ভবন তৈরি হয়। সূরা ইসরার মধ্যে যুগ যুগ ধরে নবীদের পুরাতন এবাদতের উক্ত খালি স্থানকে 'মসজিদে আকসা' বলা হয়েছে। খালি স্থানকে মসজিদ বলার কারণ হল, সেটি ইবাদতের স্থান ছিল। পরবর্তীতে সেখানে মসজিদে সাখরা ও মসজিদে আকসা নামে ২টি মসজিদ তৈরি হয়। যদিও মসজিদে সাখরা মূলতঃ মসজিদে আকসারই অংশ। উলামায়ে কেরামের মতে, মসজিদে আকসা বর্তমান মসজিদ ভবন ছাড়াও আরো বিরাট অংশের নাম। বরং ইসলামী শরীয়াতের দৃষ্টিতে বিভিন্ন গেইট বিশিষ্ট বড় দেয়ালের ভেতরের সবটুকু অংশই মসজিদে আকসা। মসজিদে আকসা মূলতঃ ইবাদতের একটি বিরাট খালি স্থানের নাম। ঐ খালি স্থানের অংশ বিশেষের উপর মসজিদে আকসা ও সাখরা নির্মিত হয়েছে। বাকী অংশটুকু চারদিক থেকে দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত ।মসজিদে আকসা পুরাতন জেরুসালেম শহরের দক্ষিণ-পূর্বদিকে অবস্থিত।

মসজিদে আকসার কারণে জেরুজালেমের মর্যাদা 

মসজিদে আকসার কারণেই মূলতঃ জেরুসালেম শহরের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। হযরত ইবরাহীম (আ) থেকে শুরু করে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা) পর্যন্ত প্রায় অধিকাংশ নবী সেখানে ইবাদাত করেছেন। এখান থেকেই মিরাজ সংঘটিত হয়েছে এবং মিরাজেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করা হয়েছে। এ প্রসংঙ্গে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেছেন : 

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِالْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ 

অর্থ : 'সেই সত্তার জন্য পবিত্রতা যিনি তাঁর বান্দাহকে মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকাসায় রাতে সফর করিয়েছেন। মসজিদে আকসার আশেপাশে আমরা বরকত নাযিল করেছি। যেন আমরা তাঁকে আমাদের নিদর্শন দেখতে পারি। নিঃসন্দেহে তিনি সর্বাধিক শ্রোতা ও দ্রষ্টা।' (সূরা আল ইসরা : ১) এ আয়াতে আল্লাহ মসজিদে হারামের পর মসজিদে আকসার কথা উল্লেখ করেছেন। কুরআনে যে দু'টি মসজিদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে মসজিদে আকসা ১টি। মসজিদে আকসা ২টি বড় ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট বলে আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। ১টা হচ্ছে,অর্থাৎ রাতের সফর তথা যমীনের ভ্রমন। আর ২য় টা হচ্ছে, মিরাজের আসমানী সফর। মসজিদে আকসা যেমন যমীনের সফরের শেষ কেন্দ্র, একই সময়ে তা আসমানী সফরেরও সূচনা কেন্দ্র। অনুরূপভাবে তা মিরাজ থেকে প্রত্যাবর্তন ও মসজিদে হারামের উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রার কেন্দ্রও বটে।

মুসলমানদের প্রথম কেবলা ছিল মসজিদে আল-আকসা

 মসজিদে আকসা মুসলমানদের কাছে গত ১৪শ' বছর যাবত দুই কিবলার প্রথম কিবলা হিসেবে বিবেচিত। মসজিদে আকসা সেই তিন মসজিদের একটি, যেগুলোতে ইবাদাত ও সাওয়াবের উদ্দেশ্যে সফর করার অনুমতি রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, لا لشد الرحال إلا إلى ثلاثة مساجد: الْمَسْجِد الْحَرَام وَمَسْجِدُ الرَّسُوْلِ وَمَسْجِدُ الْأَقْصَى. অর্থ : 'তিন মসজিদ ব্যতীত সাওয়াবের উদ্দেশ্যে অন্য কোন মসজিদে সফর করা যাবে না। তিন মসজিদ হচ্ছে, মসজিদে হারাম, মসজিদে নবওয়ী ও মসজিদে আকসা।' (বুখারী ও মুসলিম)

দীর্ঘ ১৭ মাস যাবত মুসলমানগণ প্রথম কিবলাহ বাইতুল মাকদিসের দিকে মুখ করে নামায পড়েন। এই কথার দিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ কুরআন মজীদে বলেন : وَمَا جَعَلْنَا القبلة التي كُنتَ عَلَيْهَا إِلا لِنَعْلَمَ مَنْ يُتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يُنْقَلِبُ على عقبيه وان كانت لكبيرة الأعلى الذين هدى اللهُ وَمَا كَانَ اللهُ ليُضِيعَ إِيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَؤُوفٌ رّحيمَ 

অর্থ: হে নবী ! আপনি যে কিবলার উপর ছিলেন, তা এই জন্য পরিবর্তন করা হল (অর্থাৎ বাইতুল মাকদিস থেকে কা'বার দিকে) যেন আমরা জানতে পারি, কে রাসূলের অনুসরণ করে সেই সমস্ত লোকদের মাঝ থেকে, যারা নিজেদের উপর ভর করে পেছন দিকে সরে যায়। আল্লাহ যাদেরকে হোদায়েত দিয়েছেন এটা তাদের জন্য মোটেই কোন বড় বিষয় নয়। আল্লাহ আপনাদের নামায বরবাদ করবেন না। আল্লাহ মানুষের প্রতি পরম দয়ালু ও মেহেরবান।(সূরা আল বাকারা)” 

মসজিদে আকসার নামাযে ৫ল গুণ বেশি সওয়াব।

মসজিদে আকসার নামায অন্যান্য মসজিদের নামাযের চাইতে ৫শ' গুণ উত্তম। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি হাদীস রয়েছে। তিবরানী আবুদ দারদা থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, 'মসজিদে হারামের নামাযে ১ লাখ গুণ, আমার মসজিদে ১ হাজার গুণ, ও বায়তুল মাকদিসে ৫শ' গুণ সওয়াব হয়।'

ইবনে খোযায়মাহ এবং বাজ্জারও এই একই হাদীস বর্ণনা করেছেন। ইবনে মাজাহ্ হযরত আনাস থেকে বর্ণনা করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, 'ঘরে নামায পড়লে এক গুণ, মসজিদে পড়লে ২৫ গুণ, জামে মসজিদে পড়লে ৫শ' গুণ, মসজিদে আকসা ও মসজিদে নবওয়ীতে ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদে হারামে পড়লে এক লাখ গুণ সওয়াব পাওয়া যাবে।'মসজিদে আকসায় অন্যান্য ইবাদতেরও একই পরিমাণ সওয়াব পাওয়া যাবে।

তাতে কুরআন শরীফ খতম করা, রোযা রাখা, ইতেকাফ করা ও ইলম অর্জন করা মোস্তাহাব। এমন কি ইবাদতের উদ্দেশ্যে সেখানে মসজিদের প্রতিবেশীহ ওয়াও উত্তম।

বর্ণিত আছে, মসজিদে আকসায় গুনাহও অন্য জায়গার গুনাহর চাইতে বহুগুণ বেশী। কেননা, সম্মানজনক সময় ও স্থানের গুনাহ আল্লাহর প্রতি কম ভয় ওদুঃ সাহসিকতার পরিচয় বহন করে।

হযরত আনাস বিন মালিক (রা) রাসূলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, “বেহেশত বাইতুল মাকদিসের দিকে ঝুঁকে আছে। বাইতুল মাকদিসের সাখরাহ জান্নাতুল ফেরদাউস থেকে এসেছে এবং তা যমীনের জন্য কলসীস্বরূপ। সাখরা অর্থ পাথর। ইবনে ফারেস বলেছেন, আল্লাহর নবীগণ বাইতুল মাকদিস নির্মাণ ও আবাদ করেছেন। এতে এক বিঘত জায়গাও এমন নেই, যেখানে নবীরা নামায পড়েননি কিংবা ফেরেশতারা অবস্থান করেননি। রাসূলুল্লাহর (সাঃ) দাসী মাইমুনাহ বর্ণনা করে, আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল! বাইতুল মাকদিস সম্পর্কে আমাদেরকে কিছু বলুন! তখন তিনি বলেন, এটি হচ্ছে হাশর ও নগরের স্থান; তোমরা সেখানে গিয়ে নামায পড়। সেখানকার নামাযে ১ হাজার গুণ সওয়াব রয়েছে।' (ইবনে মাজাহ) আবু দাউদ শরীফে আরো একটু বেশী বর্ণিত আছে। মাইমুনাহ জিজ্ঞেস করেন, আমি যদি সেখানে যেতে না পারি? রাসূলুল্লাহ (সা) জবাবে বলেন, 'তুমি সেই মসজিদের বাতির জন্য তেল পাঠিয়ে দিলেই সেখানে যাওয়ার সওয়াব পাবে।'

মসজিদে আকসায় নামাজ সকল গোনাহ মাফের মাধ্যম

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি একই বছর হজ্জ করে এবং মসজিদে নবওয়ী ও মসজিদে আকসায় নামায পড়ে, সে মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ নবজাত শিশুর মত নিষ্পাপ হয়ে যায়। হযরত ইবনে আব্বাস (রা) থেকে আরো বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, 'কেউ যদি বেহেশতের কোন অংশ দেখতে চায়, সে যেন বাইতুল মাকদিসের দিকে তাকায় ।

রসূল সাঃ এর মিরাজের স্থান 

হিজরাতের এক বছর কয়েক মাস আগে ২৭শে রজব, রাসূলুল্লাহর (সাঃ) ঐতিহাসিক মিরাজ বা আসমানী সফর অনুষ্ঠিত হয়। সেই মিরাজের প্রতি নির্দ্বিধায় বিশ্বাস স্থাপন করে। হযরত আবু বকর (রা) 'সিদ্দিক' উপাধি লাভ করেন। মিরাজের প্রতি বিশ্বাস মুসলমানদের ঈমানের অঙ্গবিশেষ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, তিনি (নবী) জিবরীল (আ)-কে সিদরাতুল মুনতাহার কাছে দেখেছেন। সেখানে রয়েছে জান্নতুল মাওয়া। যখন সিদরাহকে ঢেকে রেখেছিল সেই জিনিস, যা তাকে ঢেকে রাখে। (নবীর) চোখ ভুল দেখেনি এবং আদেশ অমান্য করেনি। তিনি তাঁর রবের বিরাট নিদর্শন দেখতে পেয়েছেন। (সূরা নাজম : ১৩-১৮) সেই ঐতিহাসিক মিরাজ উপলক্ষে রাতে রাসূলুল্লাহর (সা) নেতৃত্বে ফেরেশতারা মসজিদে আকসায় সমবেত হয়েছিলেন। সেখানেই তিনি আম্বিয়ায়ে কিরামকে সাথে নিয়ে নামায পড়েন ও নিজে নামাযের নেতৃত্ব দেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ বুঝিয়ে দেন যে, ইমাম ও ইমামতির কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে তা মক্কায় স্থানান্তরিত হয়ে গেছে। 

বাইতুল মাকদিসের হিফাজত বিরাট ইসলামী দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ (সা) মুসলমানদেরকে সেই দায়িত্ব-কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে তাকিদ দিয়ে বলেছেন, হে মুআজ! আল্লাহ আমার পরে তোমাকে সিরিয়ার উপর বিজয় দান করবেন। মিসরের আরীস থেকে ইরাকের ফোরাত পর্যন্ত তোমরা বিজয় লাভ করবে। তাদের নারী ও পুরুষেরা কিয়ামাত পর্যন্ত এই ভূমির হেফাজতে নিয়োজিত থাকবে। তোমাদের কেউ যদি সিরিয়া উপকূল কিংবা বাইতুল মাকদিসকে বসবাসের জন্য নির্বাচন করে, সে কিয়ামাত পর্যন্ত জিহাদের মধ্যে নিয়োজিত বলে পরিগণিত হবে।

বাইতুল মাকদিস প্রথম দিন থেকেই আল্লাহর একটি স্ট্রাটেজিক বা কৌশলগত স্থান। এই কারণে তিনি মে'রাজের ঘটনার মাধ্যমে তাকে ইসলামের অধীন করে দিয়েছেন।

ভুল নিরসন 

অনেকে মসজিদে আকসাকে মক্কা ও মদীনার দুই হারাম শরীফের মত ৩য় হারাম শরীফ হিসেবে বিবেচনা করেন। কিন্তু গোটা মুসলিম উম্মাহ এ বিষয়ে একমত যে, মসজিদে আকসা 'হারাম শরীফ' নয়। (ইকতিদাউস সিরাতিল মুস্তাকীম, পৃঃ ৪৩৪) অনুরূপভাবে, শেখ আবু বকর আবু যায়েদ ও তাঁর 'মু'জাম আল-মানাহী আল্লাফজিয়া' গ্রন্থে এবং শেখ মোহাম্মদ সালেহ ওসাইমিন তাঁর 'ফারায়েদুল ফাওয়ায়েদ গ্রন্থে একই কথা বলেছেন। ইমাম ইবনে তাইমিয়ার মতে, জেরুজালেমের হারাম শরীফ কিংবা আল-খলীল শহরের মসজিদে ইবরাহীমকে 'হারামে ইবরাহীমি' বলা ঠিক নয়। তাঁর মতে, বাইতুল মাকদিসে 'হারাম' শরীফ নামে কোন স্থান নেই। (আল-ফাতাওয়া আল-কোবরা, ২৭ খণ্ড, পৃঃ ১৪)

উপসংহার

উপরোক্ত তাৎপর্য ও ফজিলত ছাড়াও এই মসজিদের আরো অনেক ফজিলত রয়েছে। এখানে শুধু বিশেষ বিশেষ কিছু উল্লেখ করা হলো। এত বরকত ও ফজিলতময় স্থান ইহুদীদের দখলে আমরা দোয়া করি আল্লাহ যেন মুসলমানদের কে মসজিদে আল-আকসা ফিরিয়ে দেন। আমিন।

About the author

Somadanmedia
A trusted platform of Education-Culture & News and Islamic Matters And online trip's

Post a Comment