কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী কাবিল কর্তিক হাবিলকে হত্যা করার ঘটনাই মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম হত্যাকাণ্ড। হিংসায় বশীভূত হয়ে কাবিল আপন ছোট ভাই হাবিলকে হত্যা করেছিল। হিংসার কারণ হলো আল্লাহ তাআলা কাবিলের কোরবানি কবুল করেন নাই বরং হাবিলের কুরবানী কবুল করেছিলেন। হাবিল এবং কাবিল কেন আল্লাহ তাআলার জন্য কুরবানী দিয়েছিল তা কুরআনে কারীমে বর্ণিত হয়নি তবে হাদীস শরীফে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
কুরআনে বর্ণিত হাবিল কাবিলের ঘটনা।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, আদমের দু’ পুত্রের বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শোনাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল তখন একজনের কোরবানির কবুল হলো অন্যজনের কবুল হলো না। তাদের একজন বলল আমি তোমাকে হত্যা করবই। অপরজন বলল আল্লাহ মুত্তাকীদের কুরবানী কবুল করেন। আমাকে হত্যা করার জন্য আমার প্রতি তুমি হাত বাড়ালেও তোমাকে হত্যা করার জন্য আমি হাত বাড়াবো না। আমি তো জগৎসমূহের রব আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে তুমি আমার ও তোমার পাপের ভার বহন করে জাহান্নামি হও এবং এটা জালিমদের কর্মফল। তারপর তার প্রবৃত্তি তাকে তার ভাইকে হত্যায় প্ররোচিত করলো এবং সে তাকে হত্যা করল, ফলে সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হলো।
তারপর আল্লাহ তায়ালা একটি কাক পাঠালেন যে তার ভাই এর লাশ কিভাবে গোপন করা যায় তা দেখাবার জন্য মাটি খুঁড়তে লাগলো। সে বলল হায় আমি কি এ কাফের মত হতে পারলাম না যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি? তারপর সে অনুতপ্ত হলো। সূরা মায়েদা আয়াত নং২৭-৩১
পবিত্র কোরআনে পাকে হাবিল কাবিলের ঘটনা এ পর্যন্তই বর্ণিত হয়েছে। তবে বিশদ বর্ণনা তাফসির এবং হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে।
তাফসির ও হাদিসের আলোকে হাবিল কাবিলের ঘটনা।
তাফসীরে ইবনে জাবির এর মধ্যে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাঃ হতে বর্ণিত হাদিসের অনুযায়ী ঘটনার সারসংক্ষেপ হলো এই। আদম আলাইহিস সাল্লাম এক গর্ভের পুত্র সন্তানের সঙ্গে অন্য গর্ভের কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিতেন। কাবিরের জমজ বোন ছিল অত্যন্ত রূপসী এবং হাবিলের জমজ বোন ততটা রূপসী ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী হাবিলের বিবাহ কাবিলের বোনের সাথে এবং কাবিলের বিবাহ হাবিলের বোনের সাথে হওয়ার কথা। কিন্তু কাবিল নিজের যমজ বোনকে ভাইয়ের সাথে বিবাহ না দিয়ে। নিজের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করতে চাইলেন। আদম আলাইহিস সালাম হাবিলের সাথে তাকে বিবাহ দেওয়ার আদেশ করলে সে তা অগ্রাহ্য করল। ফলে আদম আলাইহিস সালাম তাদেরকে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন এবং বললেন যার কুরবানী কবুল হবে সে সুন্দরী মেয়েকে বিবাহ করবে। কাবিলের জমজ বোনের নাম ছিল আকলিমা আর হাবিলের জমজ বোনের নাম ছিল লিওযা।
আদম আঃ এর কথামতো দুজনে কুরবানী করল। কাবিল যেহেতু চাষাবাদের কাজ করতো তাই সে নিজের উৎপাদিত এক বোঝা শস্য উপস্থিত করলো। এবং হাবিল যেহেতু দুম্বা পালন করতো তাই সে মোটাতাজা একটি দুম্বা উপস্থিত করল। ঔ জমানার কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন মোতাবেক আকাশ থেকে আগুন এসে হাবিবের কোরবানি কে জালিয়ে দিল। এবং হাবিলের কোরবানি কবুল হওয়ায় হিংসার বশীভূত হয়ে কাবিল হাবিলকে হত্যা করার হুমকি দিল।
একদা হযরত আদম আঃ হজে গমন করলেন তার অনুপস্থিতিতে কাবিল হাবিলকে হত্যা করে ফেলল। বুখারী ও মুসলিম শরীফে আব্দুল ইবনে মাসুদ রাঃ থেকে বর্ণিত, কাবিল সর্বপ্রথম মানব হত্যার সূচনা করেছে যার ফলে কিয়ামত পর্যন্ত অন্যায় ভাবে যত হত্যা হবে তার একটি অংশ কাবিলের আমলনামার মধ্যে লেখা হবে।
কাবিলের হত্যার হুমকির জবাবে হাবিলের এ বক্তব্য তার উত্তম চরিত্র ও খোদাভীতি এবং তার ভাই তার ক্ষতিসাধন করার যে সংকল্প ব্যক্ত করেছিল তার প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গেই সহি বুখারী ও মুসলিমে রাসূলুল্লাহ সাঃ থেকে বর্ণিত আছে যে তিনি বলেন, তরবারি উঁচিয়ে দু’ মুসলিম মুখোমুখি হলে হত্যাকারী ও নিহত ব্যক্তি দুজনেই জাহান্নামে যাবে এ কথা শুনে সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাঃ হত্যাকারী জাহান্নামে যাওয়ার কারণটা তো বুঝলাম কিন্তু নিহত ব্যক্তি জাহান্নামে যাবে তার কারণ? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন এর কারণ সেও তার সঙ্গীকে হত্যার জন্য লালায়িত ছিল।
হাবিলের দাফন
বর্ণিত আছে যে, কাবিল হাবিলকে হত্যা করে এক বছর পর্যন্ত, অন্য বর্ণনামতে একশত বছর পর্যন্ত নিজের পিঠে রেখেছিল। এরপর আল্লাহ তাআলা দুটি কাক প্রেরণ করেন। সুদ্দী রঃ সনদসহ কতিপয় সাহাবীর বরাতে বর্ণনা করেন যে, দুই ভাই সম্পর্কীয় দুটি কাক পরস্পর ঝগড়া করে একজন অপরজনকে হত্যা করে ফেলে তারপর মাটি খুঁড়ে তাকে দাফন করে রাখে। তখন কাবিল এই দৃশ্য দেখে বলল, হায়! আমি কি এ কাকের মত হতে পারলাম না যাতে আমার ভাইয়ের লাশ গোপন করতে পারি। এবং সে অনুতপ্ত হলো। অতঃপর কাকের ন্যায় হাবিলকে দাফন করলো।
মুজাহিদ রঃ উল্লেখ করেন যে, কাবিল যেদিন তার ভাইকে হত্যা করেছিল, সেদিনই নগদ নগদ তাকে এর শাস্তি প্রদান করা হয়। মাতা পিতার অবাধ্যতা, ভাইয়ের প্রতি হিংসা এবং পাপের শাস্তি স্বরূপ তার পায়ের গোছাকে উরুর সাথে ঝুলিয়ে মুখমন্ডলকে সূর্যমুখী করে রাখা হয়েছিল। হাদিসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাঃ বলেছেন, পরকালের জন্য শাস্তি সঞ্চিত রাখার সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা দুনিয়াতেও তার নগদ শাস্তির প্রদান করেন। শাসকের বিরুদ্ধাচারণ ও আত্মীয়তা ছিন্ন করার মত জঘন্য অপরাধ আর নেই।
আমাদের শিক্ষা
১, হিংসা পরিহার করা, কেননা কাবিল হিংসায় বশীভূত হয়েই হাবিলকে হত্যা করেছিল।
২, পিতা মাতার অবাধ্য না হওয়া, কেননা কাবিল নিজ পিতার আদেশ অমান্য করেছিল যার ফলে সে জালেম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
৩, কোন নারীর প্রেমে পড়ে অন্য কাউকে হত্যা না করা, কেননা তার পরিণাম অত্যন্ত জঘন্য খারাপ।
৪, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করা, যেমন হাবিল আল্লাহ তালাকে ভয় করেছিল।
৫, সমর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কাউকে হত্যা করা ইচ্ছা পোষণ না করা।
৬, তাছাড়াও আরো বহু সংখ্যক উপদেশ এই ঘটনার মধ্যে রয়েছে যা অনুসন্ধানী গনের কাছে উন্মোচিত হয়।
উপসংহার
কুরআনে পাকে বর্ণিত হাবিল এবং কাবিলের ঘটনা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলকে দুনিয়া সকল ধরনের গুনাহের কাজ থেকে হেফাজত করুক। বিশেষ করে অন্যায় ভাবে কাউকে হত্যা করার মত জঘন্য অপরাধ থেকে হেফাজত করুন।