কুরআনে বর্ণিত রহস্যময় গাড় হলুদ রঙের গাভীর ঘটনা

 কুরআনে বর্ণিত বহু আলোচিত ঘটনা সমূহের মাঝে একটি হলো, আল্লার বিশেষ নবী হযরত মুসা আঃ এর যমানায় বনি ইসরাইলদের সাথে ঘটে যাওয়া গাভী যবাই কারার ঘটনা, যে ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুরআনে পাকের একটি সূরার নাম করণ করা হয়েছে সূরাতুল বাকারা। এবং বনি ইসরাইলের অপকর্মের একটি পরিচয় বহন করে এই ঘটনা।এই ঘটনায় রয়েছে অনেক রহস্য এবং শিক্ষা যা সকলের‌ই জানা থাকা দরকার। চলুন বহু রহস্য ও শিক্ষা সম্বলিত গাভীর ঘটনা আলোচনা জেনে নেই।

কুরআনে বর্ণিত রহস্যময় গাড় হলুদ রঙের গাভীর ঘটনা

গাভী যবাই কারার ঘটনার সূচনা

বনি ইসরাইলের এক ব্যক্তির নাম ছিল আমিল সে প্রচুর সম্পদের অধিকারী ছিল পাশাপাশি তার কোন সন্তান ছিল না। তাকে তার ভাতিজা সম্পদের লোভে হত্যা করে দিয়েছিল। ভাতিজা যখন দেখল এই বৃদ্ধ লোকটি তো মরতেছে না এবং লম্বা হায়াত পেয়ে যাচ্ছে। এমনকি তার মৃত্যুবরণ করার কোন আলামত‌ও প্রকাশ পাচ্ছে না। এদিকে ভাতিজা উত্তরাধিকার পাওয়ার লোভে অন্ধকার রাতে তাকে হত্যা করে অন্য কারো দরজার সামনে ফেলে দিয়ে আসে এবং নিজেই তার রক্তপন দাবি করে এবং তার হত্যার মিথ্যা অভিযোগ একে অপরের উপর দিতে থাকে। ফলাফল এমন হলো যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম। যখন পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করল। তখন এই ব্যাপারটা হযরত মূসা আঃ এর সমীপে পেশ করা হলো। হযরত মুসা আঃ চিন্তা করলেন যদি হত্যাকারীর সন্ধান না পাওয়া যায় তাহলে এই জাতির মধ্যে বড় একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের আদেশে একটি গাভী জবাই করে তার একটি অংশ মৃত ব্যক্তির শরীরে স্পর্শ করানোর জন্য বললেন। ফলে সে আল্লাহ তাআলার আদেশে জীবিত হয়ে তার হত্যাকারীর পরিচয় বলে দিবে।

বনি ইসরাইলের অমূলক প্রশ্ন

কিন্তু বনি ইসরাইলরা তাদের পুরাতন অভ্যাসের অনুযায়ী অমূলক প্রশ্ন করা শুরু করে দিল। তারা প্রথমে প্রশ্ন করল এই গাভীর বয়স কেমন হবে? মুসা আঃ বলেন আল্লাহতালা বলেছেন গাভীটি বেশি বয়স্ক হবে না এবং কম বয়স্ক হবে না বরং উভয়টির মাঝামাঝি বয়সের হবে। সুতরাং তোমাদের যা আদেশ করা হয়েছে তা তোমরা পালন করো। তারা আবার প্রশ্ন করল, এই গাভীটির রং কেমন হবে? মুসা আঃ বললেন আল্লাহ তাআলা বলেছেন গাভিটির রঙ হবে ঘাঢ় হলুদ যা দর্শকদের আনন্দ দেয়। তারা আবার প্রশ্ন করল, এই গাভীটি কেমন হবে? চাষাবাদে অব্যস্থ নাকি অন্য কিছু। কেননা গাভী আমাদের কাছে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। আল্লাহ তা'আলা যদি চায় তাহলে আমরা অবশ্যই সঠিক গাভীর দিশা পাব। মুসা আঃ বললেন এটা এমন একটি গাভী যা জমি চাষে অভ্যস্ত নয়। পানি সেঞ্চন করার কাজই অবস্থা নয়। একদম সুস্থ সবল তার মধ্যে কোন দাগ নেই। তারা বলল এখন আপনি সঠিক গাভীর পরিচয় তুলে ধরেছেন। তারা এই গাভীটি খোঁজাখুঁজি করা শুরু করে দিল। পরিশেষে এই গুণাগুণ সম্পন্ন একটি গাভী একজন ব্যক্তির কাছে পায়ে গেল। যে তার মায়ের অত্যন্ত আনুগত্য ছিল এবং ওই গাভীর চামড়া ভরে স্বর্ণ দিয়ে তাকে ক্রয় করল। অতঃপর এই গাভীটি জবাই করে তার জিব্বা মৃত ব্যক্তির শরীরে লাগালো। আরেক বর্ণনায় পাওয়া যায় তার লেজের গুড়া মৃত ব্যক্তির শরীরে লাগালো। তার সাথে সাথে ওই মৃত ব্যক্তির জীবিত হয়ে গেল এবং তার হত্যাকারির নাম বলে দিল। পরিনামে হত্যাকারীকে হত্যা করার অপরাধে মিরাহ থেকে বঞ্চিত করা হলো এবং খুনের বিনিময়ে তাকেও হত্যা করা হলো।

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যদি তারা কোন প্রশ্ন না করে যেকোন একটি গাভী যবাই করতো তাহলেই আল্লাহ তায়ালর আদেশ পালন করা হয়ে যেত। তারা এটা না করে যত প্রশ্ন করল তত‌ই আদেশ পালন করা কষ্টকর হয়ে উঠল।আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলের এই নিয়ম উল্লেখ করে আমাদের কে শিক্ষা দিয়েছেন যে অযথা কোন ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করাটাই উত্তম। কেননা অযথা বাড়াবাড়ি করার কুফল আমাদের কে আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন।

ইনশাআল্লাহ বলার উপকার

শেষ পর্যায়ে বনি ইসরাইলের লোকেরা বলেছিল ইনশাআল্লাহ আমরা সঠিক গাভীর সন্ধান পাব। হাদিসে বলা হয়েছে যদি তারা ইনশাআল্লাহ না বলতো তাহলে কখনোই এই গাভীর সন্ধান পেত না। যখন তারা আল্লার ইচ্ছার সাথে নিজেদের কে সংযুক্ত করল তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের কে সঠিক গাভীর সন্ধান দিলেন। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কে শিখিয়েছেন যে, যেকোন কাজের আগে অবশ্যই ইনশাআল্লাহ বলতে হবে।এতে করে আমাদের কাজ টি সুন্দর ভাবে সম্পাদন হবে।

গাভী যবাই কারার রহস্য

বনি ইসরাইলেরা বাছুর পূজা করা এবং গাভী পূজারিদের সাথে চলা ফেরা করার কারণে তাদের অন্তরে বাছুর বা গাভীর প্রতি একধরনের মুহাব্বত সৃষ্টি হয়ে গেছে আল্লাহ তায়ালা তাদের হাতে গাভী যবাই করে তাদের অন্তর থেকে গরুর প্রতি তাদের যে ভালবাসা তা দূর করে দিয়েছেন। 

যে ব্যক্তির কাছে গাভীটি পাওয়া গিয়েছিল তার আলোচনা।

 বনি ইসরাইলে একজন নেককার ব্যক্তি ছিল, তার ছিল একটি বাছুর, সে ব্যক্তি বাছুর কে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহ তাআলার কাছে দোয়া করলেন এই বাছুরটিকে আপনার হাওয়ালায় ছেড়ে দিয়ে গেলাম।তার একটি ছেলেও ছিল।সে বলল যখন আমার ছেলে বড় হবে তখন সে এই বছরটির দারা যেন উপকৃত হতে পারে। এর কয়েক দিন পরে সে নেককার ব্যক্তিটি ইন্তেকাল করলেন।আর বাছুর জঙ্গলে আল্লাহর তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হচ্ছিল।ঐ দিকে সৎ ব্যক্তির ছেলে বড় হলো। এবং অনেক কষ্টে জীবন যাপন করতে ছিল। বর্ণিত আছে যে সে ছিল মায়ের ভক্ত এক সহজ সরল ছেলে।সে কাঠ কেটে তা বাজারে বিক্রি করে যে টাকা পেত তা তিন ভাগ করত এক ভাগ দান করে দিত আরেক ভাগ নিজে খরচ করত আরেক ভাগ মাকে দিত।এমন ভাবে রাতকেও তিন ভাগ করত এক ভাগ ইবাদত করত আরেক ভাগ মায়ের সেবা করত আরেক ভাগ ঘুমাত।

একদিন তার মা তাকে বলল তোমার পিতা তোমার জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে একটি গাভী জ‌ঙ্গলে আল্লাহর নামে ছেড়ে দিয়ে গেছেন।তুমি জ‌ঙ্গলে গিয়ে হযরত ইব্রাহীম আঃ ও হযরত ইয়াকুব আঃ ও ইসহাক আঃ এর প্রভুর কাছে দোয়া কর যেন তিনি এই গাভীটি তোমাকে দিয়ে দেন। গাভীটি পরিচয় হলো তা গাড় হলুদ রঙের হবে কোন দাগ থাকবেনা।

অতঃপর ছেলে জ‌ঙ্গলে গিয়ে গাভীটি কে দেখে বলল হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল ও ইসহাক আঃ এর প্রভুর দোঁহায় দিয়ে বলছি তুই আমার কাছে চলে আস তখন গাভীটি চলে আসলো।ছেলেটি গাভীর ঘাড়ে ধরে বারিতে নিয়ে আসতে ছিল। আল্লাহ তায়ালা গাভীর যবান খুলে দিল গাভী বলল তুমি আমার পিঠে উঠে বস তাহলে তোমার আরাম হবে।ছেলে বলল না আমার আমাকে বলে দিয়েছে ঘাড়ে ধরে নিতে।তখন গাভীটি বলল তাহলে ভাল‌ই হলো,যদি তুমি আমার পিঠে উঠে বসতে তাহলে আমি তোমার বাধ্য হতাম না।

যখন ছেলেটির গাভীটিকে নিয়ে বাড়িতে গেল তখন মা বলল তুমি অনেক গরীব তোমার এই গভীটি কে বিক্রি করে দেওয়া উচিত। তুমি গাভিটিকে বাজারে নিয়ে যাও এবং তিন দিনারে বিক্রি করে দাও। ছেলে গাভিটিকে নিয়ে বাজারে গেল, তখন একজন ক্রেতা তাকে বলল, গাভীটি কত দিয়ে বিক্রি করবে? সে বলল গাভিটি আমি বিক্রি করব তিন দিনারে আরে তবে আমার মার কাছে পরামর্শ করে তারপর বিক্রি করব। ওই আগন্তক ব্যক্তি ছিল আল্লাহতালার পক্ষ থেকে প্রেরিত এক ফেরেশতা, যে তার পরীক্ষা করার জন্য এসেছে। সে মায়ের কতটুকু আনুগত্য করে। ফেরেশতা বলল, আমি তোমাকে ছয় দিনার দিব তবে শর্ত হলো তোমার মায়ের কাছে জিজ্ঞাসা করা ব্যতিত বিক্রি করতে হবে। ছেলেটি বলল তা সম্ভব নয়। তখন সে গাভী নিয়ে বাড়িতে গেল তার মায়ের কাছে ঘটনা খুলে বলল।তার মা বলল ছয় দিনার এর কমে আমার পরামর্শ ছাড়া বিক্রি করবে না। তারপর আবার গাভিটিকে বাজারে নিয়ে গেল এবং ওই লোকটি আবার বলল, তোমার মা কি পরামর্শ দিয়েছেন। সে বলল আমার মা আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যেন ছয় দিনারের কমে মায়ের পরামর্শ ব্যতীত বিক্রি না করি। তখন ওই লোকটি বলল আমি তোমাকে ১২ দিনার দেবো, তবে শর্ত হলো তোমার মায়ের পরামর্শ ব্যতীত বিক্রি করতে হবে। ছেলে বলল তা আদৌ সম্ভব নয়। তখন সে আবার তার মায়ের কাছে গেল এবং ঘটনা খুলে বলল, তার মা বলল মনে হয় তোমার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলার কোন ফেরেশতা প্রেরণ করেছেন। তুমি তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস কর আমরা এই গভীটি বিক্রি করব কিনা। ছেলে এবার গেল এবং আগন্তুক কে বলল আমরা এই গাভীটিকে এখন বিক্রি করব কিনা। তখন ওই ফেরেস্তা বলল, না তোমার মাকে গিয়ে বলবে এখন আপাতত এই গাভীটি যেন বিক্রি না করে বেঁধে রাখে।

 কারণ মূসা আঃ ক‌উমের মধ্যে এক ব্যক্তি মারা গেছে সেই ব্যক্তিকে জীবিত করার জন্য আল্লাহ তায়ালা বিশেষ ধরনের একটি গাভী যবাই করার নির্দেশ দিয়েছেন। যখন তারা আসবে তখন এই গাভীটি জবাই করে তার চামড়া ভর্তি স্বর্ণ দেয়ার আগ পর্যন্ত তোমরা তাকে বিক্রি করবে না। পরে তাই হলো,ছেলেটি গাভীকে তার চামড়া ভর্তি স্বর্ণ দিয়ে বিক্রি করে দিল।এভাবে আল্লাহ তায়ালা তাকে ধনী বানিয়ে দিল।

আল্লাহ তাআলার কুদরতি কারিশ্মা 

আল্লাহ তাআলা একটি গাভীকে জবাই করার মাধ্যমে বনী ইসরাইলদের অন্তর থেকে বাছুর পূজার মোহাব্বত বের করে দিয়েছেন এবং এই গাভীর একটি অংশ মৃত ব্যক্তির শরীরে লাগানোর ফলে সে জীবিত হয়ে মৃত ব্যক্তির নাম বলে দেওয়ার দ্বারা বিশাল বড় একটি আগত বিশৃঙ্খলা কে দূর করে দিয়েছেন এবং মায়ের ভক্ত এক দরিদ্র ছেলেকে ধনী বানিয়ে দিয়েছে। এবং মুসা আঃ সালামের বড় একটি মুজেযাও প্রকাশিত করেছেন।

উপসংহার

উপর উল্লেখিত ঘটনা দ্বারা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কুদরতের কারিশমা আমরা জানতে পারলাম ।আল্লাহ তা'আলা যেন আমাদেরকে উক্ত ঘটনাকে অনুধাবন করে তার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দুনিয়া ও আখেরাতের সফল হতে পারি সে তৌফিক কামনা করছি। সূত্র: মুফতী মুনির হুসাইন

About the author

Somadanmedia
A trusted platform of Education-Culture & News and Islamic Matters And online trip's

Post a Comment