শবে কদর শব্দটি ফার্সি, শব অর্থ রাত বা রজনী,কদর অর্থ সন্মানিত, মহিমান্বিত,ভাগ্য।এই রাতে আল্লাহ তায়ালা কুরআন নাযিল করেছেন, ফেরেশতারা অবতীর্ণ হয়, আল্লাহর রহমত অবতীর্ণ হয়, তাই তাকে শবে কদর করে নাম করা হয়েছে। এই রাত্রে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেকের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেন বলে তার নামকরণ করা হয়েছে ভাগ্য রজনী। যার আরবি শব্দ হলো লাইলাতুল কদর।
মুসলিমদের মর্যাদা পূর্ণ রাত সমূহের মধ্যে থেকে একটি হলো লাইলাতুল কদর, এই রাত্রে ইবাদত করার রয়েছে বহু ফজিলত ও সাওয়াব, আল্লাহ তায়ালা বলেন, লাইলাতুল কদর হাজার মাস ইবাদত করা থেকে উত্তম। তথা ৮৩ বছর চার মাস ইবাদত করা থেকে উত্তম।
লাইলাতুল কদর কখন
লাইলাতুল কদর কখন তা সুনিশ্চিত ভাবে বলা যাবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে গোপন রেখেছেন। যেন মানুষ বেশি বেশি এবাদত বন্দেগীতে সময় ব্যয় করতে পারে। তবে রমজান মাসে শেষ দশকের বেজোড় রাত্র সমূহ তথা ২১,২৩,২৫,২৭,২৯ লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রসূল সাঃ বলেন, তোমরা রমজান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে লাইলাতুল কদর তালাশ কর। বুখারী শরীফ হাদিস নং ২০১৭
হযরত যির ইবনে হুবাইশ রহঃ বর্ণনা করেন হযরত উবাই ইবনে কায়াব রাঃ কে লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম এবং বললাম আপনার ভাই আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলে থাকেন, যে ব্যক্তি পূর্ণ এক বৎসর রাত্রি জাগরণ করবে, সে লাইলাতুল কদর পাবে নিশ্চিত। তার উত্তরে হযরত উবাই ইবনে কায়াব রাঃ বলেন, আল্লাহ তার উপর রহম করুন, তিনি ইচ্ছা করেছেন লোকেরা যেন এক রাতের উপর ভরসা করে বসে না থাকে। অবশ্যই তিনি জানেন তা রমজানে এবং তিনি এও জানেন যে তা রমজানের শেষ দশকে এবং ২৭ তারিখে। অতঃপর হযরত উবা ইবনে কায়াব শপথ করে বলেন অবশ্যই তার ২৭ তারিখের রাত্রেই হয়ে থাকে। আমি বললাম হে আবুল মনযির! “হযরত উবাই ইবনে কায়াবের উপনাম” এটা কিসের উপর ভিত্তি করে বলেছেন? উত্তরে তিনি বলেন, আলামত বা নিদর্শনের ভিত্তিতে যা রসুল সাঃ আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, যে সেদিন সূর্যের কিরণ থাকে না। মুসলিম শরীফ হাদিস নং ৭৬২
তবে কিছু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয় লাইলাতুল কদর ২৭ তারিখের রাত্রে হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
লাইলাতুল কদরের আলামত বা নিদর্শনসমূহ
এক, লাইলাতুল কদরের বৃষ্টি হবে, হযরত আবু সাঈদ রাঃ বলেন, আমরা রাসুল সাঃ এর সাথে রমজানের মাঝের দশ দিন এতেকাফ করেছি রাসুল সাঃ ২০ শে রমজান সকাল বেলা আমাদেরকে ভাষণ দিয়ে বলেন, আমাকে লাইলাতুল কদর দেখানো হয়েছিল। অতঃপর ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বা আমি ভুলে গিয়েছি। সুতরাং তোমরা শেষ দশকের বেজোর রাত্রে তা অন্বেষণ কর। আমি দেখতে পেয়েছি যে আমি ওই রাত্রে কাদা পানিতে সেজদা করছি। সুতরাং যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে এতেকাফ করেছে সে যেন ফিরে আসে তথা মসজিদ থেকে বের না হয়। আমরা আকাশে হালকা মেঘও দেখতে পাইনি, অতঃপর মেঘ দেখা দিল এবং এত প্রবলভাবে বৃষ্টি হলো, যে খেজুরের শাখার তৈরি মসজিদ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। নামাজ শুরু হলে আমি রসূল কে কাদা পানিতে সেজদা করছে দেখলাম। পরে তার কপালে আমি কাঁদার চিহ্ন দেখতে পাই। বুখারী শরীফ হাদিস নং ২০১৬
দুই, শবে কদরের সূর্য উদিত হয় উজ্জ্বল হয়ে তাতে কিরণের তিব্রতা থাকে না। হযরত উবাই ইবনে কায়াব রাঃ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে শেষ অংশে বর্ণিত আছে, রাসুল সাঃ আমাদেরকে বলে দিয়েছেন, যে সেদিন সূর্যের কিরণ থাকে না। মুসলিম শরীফ হাদিস নং ৭৬২
লাইলাতুল কদরের ফজিলত
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই রাত সম্পর্কে একটি সম্পূর্ণ সূরা নাযিল করেছেন এবং লাইলাতুল কদরের পরিচয় ও ফজিলত বর্ণনা করেছেন।
এক,এই রাত্রে ইবাদত করা হাজার মাস ইবাদত করা থেকে উত্তম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন লাইলাতুল কদর হাজার মাস ইবাদত করা থেকে উত্তম। সূরা কদর আয়াত- ৩
দুই, এই রাত্রিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সম্পূর্ণ কোরআন নাজিল করেছেন। তথা লৌহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে সম্পূর্ণ কোরআন লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছেন।বা লাইলাতুল কদরে রসূলে আকরাম সাঃ এর উপর কুরআন নাযিল হওয়ার সূচনা হয়েছে। কুরআন যেহেতু মর্যাদাবান, তাই কুরআনের বরকতে এই রাত্রিও ফজিলত সম্বলিত ও মর্যাদাবান হয়ে গেল।
তিন, এই রাতে ফেরেশতা গন ও জিব্রাইল আঃ প্রত্যেক কাজে তাদের পালনকর্তার অনুমতি ক্রমে অবতীর্ণ হয়। সূরা কদর। আয়াত-৪
ফেরেশতাগণ এই রাত্রে অবতীর্ণ হওয়ার দুটি উদ্দেশ্য হতে পারে। এই রাত্রে যারা এবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকে, ফেরেশতারা তাদের জন্য দোয়া করে। যেন আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি রহমত বর্ষণ করেন। দুই, দ্বিতীয় উদ্দেশ্য এই আয়াতে বলা হয়েছে যে সারা বৎসরে যা কিছু ঘটবে বলে ভাগ্যে ফায়সালা হয়ে আছে, আল্লাহ তাআলা তা এই রাত্রে ফেরেশতাদের উপর ন্যস্ত করেন। যেন যথাসময়ে তা কার্যকর করে। প্রত্যেক কাজের অবতীর্ণ হওয়ার এই ব্যাখ্যাই মুফাসসিরগণ করেছেন।
চার,শবে কদর শান্তির রাত, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, শান্তিই শান্তি, তা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।তথা এই রাতে ফেরেশতা গন মুমিনদের কে সালাম জানায়, এই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য শুধু কল্যান ও শান্তির ফায়সালা করেন। সূরা কদর আয়আত- ৫
পাঁচ, শবে কদরের রাত হলো বরকতময় রাত। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি ভীতি প্রদর্শন কারী। সূরা আদ-দুখান আয়াত -৩
ছয়, শবে কদরে ইবাদত করার দ্বারা পূর্বের সকল গুনাহ মাফ হয়ে যায়। হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত সওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাইলাতুল কদরের ইবাদতে রাত্রি জাগরণ করবে তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে। বুখারী শরীফ হাদিস নং ৩৫
সাত,আল্লাহ তায়ালা শবে কদর দিয়েছেন যেন উম্মতে মোহাম্মদীরা কম সময়ে বেশি সাওয়াব হাসিল করতে পারে। হযরত মালেক রহঃ বলেন নির্ভরযোগ্য আহলে এলেমগন কে বলতে শুনেছেন রসুল সাঃ কে তার পূর্বের নবীগনের উম্মতের আয়ু দেখানো হয়। অথবা তা হইতে যতটুকু আল্লাহ চাহিয়াছেন তা দেখিয়েছেন। ফলে তিনি তার উম্মতের আয়ুকে সংক্ষিপ্ত মনে করিলেন। যার কারণে আমলের দিক দিয়ে পূর্ববর্তী উম্মতের সমপর্যায়ে পৌছতে সক্ষম হবে না। অতঃপর আল্লাহ তাআলা তাকে হাজার মাস হতে উত্তম রজনী দান করেছেন।মুয়াত্তা মালেক হাদিস নং ৮৯৬
লাইলাতুল কদরের দোয়া
হযরত আয়েশা রাঃ বলেন আমি রসূল সাঃ কে বললাম হে আল্লাহর রাসূল সাঃ আমাকে বলে দিন যদি আমি লাইলাতুল কদরের রাত্রি সম্পর্কে জানতে পারি তাহলে তাতে আমি কি দোয়া করব রাসুল সাঃ বলেন তুমি বলবে আল্লাহুম্মা ইন্নকা আফুয়ুন তুহাব্বুল আফয়া,ফায়াফু আন্নী। হে আল্লাহ তুমি ক্ষমাশীল এবং ক্ষমা করাকে পছন্দ কর, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও। তিরমিযি শরিফ হাদিস নং ৩৫১৩
লাইলাতুল কদরের আমল
১- বেশি বেশি নফল নামাজ আদায় করবে।
২- যদি কাযা নামায যিম্মায় থেকে থাকে তাহলে উমরি কাযা নামায আদায় করবে।
৩- সম্ভব হলে সালাতুত তারাবীহ নামায আদায় করবে।
৪- সম্ভব হলে সালাতুল হাজত আদায় করবে।
৫- কুরআন শরীফ তেলাওয়াত করবে।
৬- তাসবিহ আদায় করবে যেমন সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ,লা ইলাহা ইল্লাহ, আল্লাহু আকবার, দরুদ শরীফ, ইস্তেগফার সবগুলো ১০০ বার করে পড়বে।
৭- দান সদকা করবে।
৮- ইতিকাফ করবে সুন্নাত ইতিকাফ সম্ভব না হলে নফল ইতিকাফ করবে।
উপসংহার
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের কে লাইলাতুল কদর পাওয়ার সৌভাগ্য দান করে বেশি বেশি সাওয়াব হাসিল করার তৌফিক দান করুক আমীন।
লিখেছেন
মুফতি মুনির হুসাইন
সিনিয়র শিক্ষক জালপট্টি মাদরাসা মাধবদী, নরসিংদী।