প্রিয় মুসলিম ভাই আমার আমরা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শুনে থাকি ইসলামী সংগীত পরিবেশন করবেন বা ইসলামী গান পরিবেশন করবেন বা আধুনিক শিল্পীদের কাছে শুনে থাকে চলো একটা গান গাই, আসলে ইসলামিক গান কিংবা ইসলামী সংগীত বলা যাবে কিনা কোরআন হাদিসে এ সম্পর্কে কি বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে আজকের এই প্রবন্ধ মনোযোগ সহকারে এই প্রবন্ধটি পড়লে আশা করি সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে পারবেন।
somadanmedia.com |
প্রথমে আমরা শব্দগুলোর অর্থ জেনে নেয়
গান শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, ১. নির্দিষ্ট সুর ও লয়ের উচ্চারিত ছন্দবদ্ধ রচনা সংগীত গান গাওয়া । ২. গীতি কবিতা। ৩. সুমধুর ধ্বনি বা রব (পাখির গান) কীর্তন বর্ণন (গুনোগান)।
গজল কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়,১. হিন্দি বা উর্দু ভাষায় রচিত গীতি কবিতা। ২. সঙ্গীতের সুর বা তাল বিশেষ। ৩. ধর্ম সঙ্গীত।
সংগীত শব্দটি কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয়, ১. গান (রবীন্দ্র সংগীত)। ২. গীতি ও বাদ্য। ৩. ছন্দ ও লয়ের সমন্বয়ে উচ্চারিত বাক্য, গীতি ও বাদ্য।
ইসলাম শব্দের সাথে উপরোক্ত শব্দগুলো মানানসই হয় কিনা
ইসলামী গান কিংবা ইসলামী সংগীত বলা যাবে কি না তা জানতে হলে আমাদের কোরআনে পাকে একটি আয়াতের তাফসীর জানতে হবে চলুন আমরা সেই আয়াত তার অর্থ তাফসির টি জেনে নেয়।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
يا أيها الذين آمنوا لا تقولوا راعنا وقولوا انظرنا واسمعوا وللكافرين عذاب أليم
অর্থ, হে মুমিন গণ, তোমরা ‘রায়িনা’ বলো না-‘উনযুরনা’ বল এবং শুনতে থাক। আর কাফেরদের জন্যে রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি।(মাওলানা মুহিউদ্দিন খান)
"রায়েনা"- অর্থ আমাদের প্রতি লক্ষ করুন। ইহুদীদের ভাষায় এর অর্থ "হে বোকা"। তাই আল্লাহ্ তায়ালা ঐ শব্দের স্থলে 'উন্যুরনা' ব্যবহারের নির্দেশ দেন।
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতি তাকী উসমানী দা:বা: কি বলেছেন চলুন জেনে নেয়া যাক
মদীনায় বসবাসকারী ইয়াহুদীদের একটি দল ছিল অতিশয় দুষ্ট। তারা যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে সাক্ষাত করত, তখন তাকে লক্ষ্য করে বলত ‘রাইনা’ (رَاعِنَا)। আরবীতে এর অর্থ ‘আমাদের প্রতি লক্ষ্য রাখুন’। এ হিসেবে শব্দটিতে কোনও দোষ নেই এবং এর মধ্যে বেআদবীরও কিছু নেই। কিন্তু ইয়াহুদীদের ধর্মীয় ভাষা হিব্রুতে এরই কাছাকাছি একটি শব্দ অভিশাপ ও গালি অর্থে ব্যবহৃত হত। তাছাড়া এ শব্দটিকেই যদি “ع” এর দীর্ঘ উচ্চারণে পড়া হয়, তবে رَاعِيْنَا হয়ে যায়, যার অর্থ ‘আমাদের রাখাল’।
মোটকথা ইয়াহুদীদের আসল উদ্দেশ্য ছিল শব্দটিকে মন্দ অর্থে ব্যবহার করা। কিন্তু আরবীতে যেহেতু বাহ্যিকভাবে শব্দটিতে কোনও দোষ ছিল না, তাই কতিপয় সরলপ্রাণ মুসলিম ও শব্দটি ব্যবহার করতে শুরু করে দেয়। এতে ইয়াহুদীরা বড় খুশী হত এবং ভেতরে ভেতরে মুসলিমদের নিয়ে মজা করত। তাই এ আয়াতে মুসলিমদেরকে তাদের এ দুষ্কর্ম সম্পর্কে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে তাদেরকে এ শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। সেই সঙ্গে এ শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে যে, যে শব্দের ভেতর কোনও মন্দ অর্থের অবকাশ থাকে বা যা দ্বারা ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা থাকে, সে রকম শব্দ ব্যবহার করা সমীচীন নয়। পরবর্তী আয়াতে এ সকল হঠকারিতাপূর্ণ আচরণের আসল কারণও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর তা এই যে, নবুওয়াতের মহা নিয়ামত মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কেন দান করা হল সেজন্য তারা ঈর্ষান্বিত ছিল। সেই ঈর্ষার কারণেই তারা এসব করে থাকে।
তাফসীরে মারেফুল কুরআনে এ আয়াতের ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছে চলুন জেনে নেয়া যাক
কোন কোন ইহুদী রসূলুল্লাহ (সা)-এর নিকট এসে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে তাঁকে ‘রায়িনা’ বলে সম্বোধন করত। হিব্রু ভাষায় এর অর্থ একটি বদ দোয়া। তারা এ নিয়তেই তা বলত। কিন্তু আরবী ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে ’আমাদের প্রতি লক্ষ্য করুন।’ ফলে আরবী ভাষীরা তাদের এই দুরভিসন্ধি বুঝতে পারত না। ভাল অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে কোন কোন মুসলমানও রাসূলুল্লাহ (সা)-কে এই শব্দে সম্বোধন করতেন। এতে দুষ্টরা আরও আশকারা পেতো। তারা পরস্পর বসে হাসাহাসি করত আর বলত, এতদিন আমরা গোপনেই তাকে মন্দ বলতাম। এখন এতে মুসলমানদেরও শরীক হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে মন্দ বলার সুযোগ এসেছে। তাদের এই সুযোগ নষ্ট করার উদ্দেশ্যে আল্লাহ্ তা’আলা নির্দেশ দিচ্ছেনঃ হে মু’মিনগণ, তোমরা ’রায়িনা’ (শব্দটি) বলো না। (এর পরিবর্তে ) ’উনযুরনা’ বলবে। (কেননা, আরবী ভাষায় ‘রায়িনা’ ও ’উনযুরনা’র অর্থ এক হলেও ’রায়িনা’ বললে ইহুদীরা দুষ্টুমির সুযোগ পায়। তাই একে বর্জন করে অন্য শব্দ ব্যবহার কর)। আর এ নির্দেশটি (ভাল রূপে) শুনে নাও ( এবং স্মরণ রাখ)। কাফিরদের জন্যে তো বেদনাদায়ক শাস্তি রয়েছেই। (কারণ, ওরা ধূর্ততা সহকারে পয়গম্বর এর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে)।
আয়াত দ্বারা বোঝা যায় যে, আপনার কোন জায়েয কাজ থেকে যদি অন্যরা নাজায়েজ কাজের আশকারা পায়, তবে সে জায়েয কাজটিও আপানার পক্ষে জায়েয থাকবে না। উদাহরণত কোন আলিমের কোন কাজ দেখে যদি সাধারণ লোকেরা বিভ্রান্ত হয় এবং নাজায়েজ কাজে লিপ্ত হয়, তবে সে আলিমের জন্য সে জায়েয কাজটিও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। তবে শর্ত এই যে, সংশ্লিষ্ট কাজটি শরীয়তের দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় হওয়া উচিত। কোরআন ও হাদীসে এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত রয়েছে। এর একটি প্রমাণ ঐ হাদীস, যাতে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, জাহেলিয়াতের যুগে কোরাইশরা যখন কা’বাগৃহ পুনঃনির্মাণ করে, তখন এতে কয়েকটি কাজই এমন করা হয়েছে, যা ইব্রাহীম (আ) কর্তৃক রচিত ভিত্তির সাথে সামঞ্জস্য শীল নয়। আমার মন চায়, একে ভেঙে আবার ইবরাহীমী ভিত্তির অনুরূপ করে দেই। কিন্তু কা’বাগৃহ ভেঙে দিলে অজ্ঞ জনগণের বিভ্রান্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাই আমি স্বীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করছি না—এ বিধানটি সমস্ত ফেকাহবিদের কাছেই গ্রহণীয়। তবে হাম্বলী মযহাবের আলেমগণ এ ব্যাপারে অধিক সাবধানতা অবলম্বনের পক্ষপাতী।(আল বাকারা, আয়াতঃ ১০৪)
উপরোক্ত তাফসিরের মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে ইসলামি গান কিংবা ইসলামী সংগীত ব্যবহার করার ফলে সাধারণ মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এবং তার মাঝে মন্দ অর্থ রয়েছে। যদিও আমরা ভালো অর্থের প্রতি লক্ষ্য করে এই শব্দগুলো বলে থাকি কিন্তু তার মন্দ অর্থটি ও কেউ উদ্দেশ্য নিতে পারে এবং বলতে পারে হুজুরেরাই তো গান গায়, সংগীত শ্রবণ করে তাহলে আমরা বাদ্যযন্ত্র শুনলে কিংবা গান শুনলে না জায়েজ হবে কেন। কাজেই ইসলামী সংগীত ও ইসলামী গান বলা যাবে না।
বিকল্প হিসেবে গজল কিংবা ইসলামী গজল বলা যেতে পারে এভাবে বলা যেতে পারে এই পর্যায়ে গজল পরিবেশন করবেন বা ইসলামী গজল পরিবেশন করবেন ইত্যাদি।
উপসংহার
প্রিয় দ্বীনি ভাই আমার আসুন আমরা বহু প্রচলিত এই শব্দগুলো প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে একটু সচেতন এবং নিজেও দুষ্ট লোকের দুষ্টুমি থেকে বাঁচি এবং মানুষদের কেও বাঁচায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ভালো কাজকে মানা এবং প্রচার করার তৌফিক দান করুক।