যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে তাহলে কখনো সে সফলতার মুখ দেখতে পারবে না দুনিয়াতেও সফল হতে পারবেনা আখিরাতেও সফল হতে পারবেনা। দুনিয়াতে সফল হতে পারবে না কারণ যে কাজগুলো সফল হওয়ার জন্য প্রতিবন্ধক সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে ঐ কাজের মধ্যে লিপ্ত হয়ে যাবে। আখেরাতের মধ্যে সফল হতে পারবেনা কারণ আখেরাতের মধ্যে বিফল হওয়ার যে সকল কাজ রয়েছে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণে ঐ সকল কাজে লিপ্ত হয়ে পড়বে। এভাবে দুনিয়া এবং আখেরাত উভয়টাই বরবাদ হবে।
![]() |
self control by somadanmedia.com |
আত্মনিয়ন্ত্রণের পরিচিতি
আল্লাহ তাআলা মানুষের মাঝে দুটি শক্তি দান করেছেন। একটি শক্তি কোনো কাজে অগ্রসর হওয়ার। অন্যটি কোনো কাজ থেকে বিরত থাকার। অগ্রসর হওয়ার এ শক্তিটি দ্বীনি ও দুনিয়াবি উপকার হয়-এমন কাজে ব্যয় করা উচিত। অন্যদিকে বিরত থাকার শক্তিটি ক্ষতিকর কাজ থেকে নিবৃত্ত থাকার জন্য ব্যয় করা উচিত। প্রতিটি মুসলিমের ওপর ভালো কাজে অগ্রসর হওয়া এবং মন্দ কাজ থেকে নিবৃত্ত হওয়া ফরজ করা হয়েছে। নিবৃত্ত থাকার এ বিষয়টিই হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণ। একজন মুসলিম নিজেকে মন্দে পতিত হওয়া থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ করবে-এটা তার ওপর ফরজ।
অতএব একজন মুসলিম নিজেকে মন্দ, গুনাহ ও অনর্থক কর্ম থেকে নিবৃত্ত রাখাই হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ।
ইবনুল কাইয়িম আত্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বলেন-
'আত্মনিয়ন্ত্রণ যতই শক্তিশালী হবে হারামের প্রতি আসক্তি, হারাম কামনা- বাসনা ও নিকষকালো ফিতনার বিরুদ্ধে একজন মুসলিম তত বেশি অটল- অবিচল হবে। অনেকে ইবাদতের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করে। কিন্তু পাপ কাজের মুকাবেলায় তার সে ধৈর্যধারণ থাকে না। আবার এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের প্রথমটিতেও সবর নেই, দ্বিতীয়টিতেও নেই। এ ক্ষেত্রে সর্বোত্তম মানুষ হলো সে. যে উভয় প্রকারেই ধৈর্যধারণ করে চলে।
উদাহরণত বলা যায়, অনেক মানুষ কি শীত, কি গরম-উভয় সময়েই কষ্ট হলেও কিয়ামুল লাইল আদায় করে, উভয় সময়েই কষ্ট করে সাওম পালন করে। কিন্তু কোনো হারাম থেকে দৃষ্টি সংযত করে না। আবার অনেক মানুষকে দেখা যায়, দৃষ্টি সংযত রাখার ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করে। কিন্তু সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ এবং মুনাফিক ও কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার ক্ষেত্রে কষ্ট স্বীকার ও ধৈর্যধারণ করে না।'
ইবনুল কাইয়িম আরও বলেন-
'কোনো মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ধৈর্য সে কাজটির প্রতি প্ররোচনার মাত্রা ও কাজটি সহজ হওয়ার মাত্রার ওপর নির্ভর করে। যখন কোনো মন্দ কাজের প্রতি তীব্র প্ররোচনা থাকে এবং কাজটি করা কারও পক্ষে সহজ হয়ে থাকে, তখন সে কাজটি থেকে বিরত থেকে ধৈর্যধারণ করাটা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাই কোনো ক্ষেত্রে যদি তীব্র প্ররোচনা ও কাজ সম্পাদনের সহজতা একই সাথে পাওয়া যায়, তবে সে ক্ষেত্রটিতে ধৈর্যধারণ করা অধিক কঠিন হয়ে পড়ে।
আর উভয়টি না থাকা অবস্থায় ধৈর্যধারণ করা সহজ হয়। যদি দুটোর একটি পাওয়া যায়, তবে ধৈর্যধারণ করা একদিক থেকে সহজ হয় এবং অন্যদিক থেকে কঠিন হয়। যেমন: হত্যা, চুরি, নেশাজাতীয় দ্রব্য পান করা, অশ্লীলতায় মত্ত হওয়ার প্রতি যদি কেউ প্ররোচিত না হয় এবং তার জন্য যদি এগুলো করা সহজ না হয়- তবে এগুলো থেকে বিরত থেকে ধৈর্যধারণ করা অধিক সহজ হয়ে থাকে। অন্যদিকে যদি এগুলোর প্রতি প্ররোচিত হওয়া ও এগুলো করা সহজ হয়, তবে এগুলো থেকে বিরত থাকা অধিক কঠিন হয়ে পড়ে।
তাই তো একজন বাদশাহর অত্যাচার থেকে বিরত থাকা, একজন যুবকের অশ্লীলতা থেকে বিরত থাকা, একজন ধনীর উপভোগে মত্ত হওয়া ও কামনা চরিতার্থ করা থেকে বিরত থাকার ফলে তারা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা-প্রাপ্ত। কারণ তাদের জন্য এ সকল কাজ থেকে বিরত থাকা অধিক কঠিন ছিল।
এ কারণেই সাত শ্রেণির লোক হাদিসে বর্ণিত বিশেষ নিয়ামতের উপযুক্ত হয়েছে। তাদের ধৈর্যধারণ ও বিরত থাকার কষ্টের পূর্ণতার কারণে আল্লাহ তাআলা তাদের আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেওয়ার ওয়াদা করেছেন।
ধৈর্য্য ধারণ করা
নিশ্চয় একজন ক্ষমতাবান নেতার বণ্টনে, বিচারে, তার ক্রোধ ও তুষ্টিতে সবর করা, একজন যুবকের আল্লাহর ইবাদতে ও প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সবর করা, একজন ব্যক্তির মসজিদের সাথে সর্বদা মনকে যুক্ত করে রাখা, একজন দানকারী নিজের দানের কথা লুকিয়ে রাখা, এমনকি নিজের অপর অংশ থেকে লুকিয়ে রাখা, যুবতির সৌন্দর্য ও বংশমর্যাদার উচ্চতা থাকা সত্ত্বেও তার অশ্লীল আহ্বানে সবর করা। একত্রিত হওয়া ও বিচ্ছিন্ন হওয়ার অবস্থায় আল্লাহর জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, এমন দুব্যক্তির সবর করা, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর নিজের এ নেক আমলের কথা অন্যের থেকে গোপন রাখা, মানুষের সামনে তা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকার ওপর সবর করা-এ সকল প্রকারের সবর অধিকতর কঠিন হয়ে থাকে।
জবান লজ্জাস্থান হেফাজত করা
জবান ও লজ্জাস্থানের পাপের ক্ষেত্রে সবর করা সবরের প্রকারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। কারণ এ দুটির প্রতি প্ররোচনা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি দিয়ে পাপ করা সবচেয়ে সহজ। জবানের পাপগুলো-যেমন: পরনিন্দা, গিবত, মিথ্যা, ঝগড়া, অতিরঞ্জিত আত্মপ্রশংসা করা, মানুষের বিভিন্ন কথিত কথা বর্ণনা করা, নিজে ঘৃণা করে এমন ক্ষেত্রে নিন্দা করা, নিজের কাছে ভালো লাগে এমন কিছুর স্তুতি গাইতে থাকা-জবানের এমন মন্দ ব্যবহারের প্রতি প্ররোচনা বেশি হয়ে থাকে, এ সকল ক্ষেত্রে জবান চালনা সহজও হয়ে থাকে, ফলে এখানটাতে এসে সবর দুর্বল হয়ে পড়ে।
আপনি এমন লোককেও পাবেন, যে রাতের বেলায় কিয়ামুল লাইল ও দিনের বেলা সাওম পালন করে, রেশমের বালিশে সামান্য সময়ের জন্যও হেলান দেওয়া থেকে দূরে থাকে-এতটা সাবধান ও সতর্ক থাকে সে। কিন্তু অন্যদিকে এ লোকই বিভিন্ন জনের সম্পর্কে নিজের জিহ্বা দিয়ে গিবত, পরনিন্দার বন্যা বইয়ে দিতে থাকে।
সব ধরনের গোনাহ থেকে মুক্ত থাকা
এমন অনেককে পাবেন, যে ছোট থেকে ছোট হারাম থেকেও বেঁচে থাকে, এক ফোঁটা মদও যেন তাকে স্পর্শ করতে না পারে, এ ব্যাপারে সে সাবধান-সামান্য সূচাগ্র পরিমাণ নাপাকিও তাকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু সে ব্যক্তিই হারাম পন্থায় নিজের লজ্জাস্থান ব্যবহারে এতটুকুও সমস্যা মনে করে না। একজন সম্পর্কে তো এমনও শুনলাম, এক লোক বেগানা এক নারীর সাথে একাকী কক্ষে। যখন যৌন-মিলনের জন্য লোকটি এগিয়ে এল, সে বলল-এ নারী, নিজের মুখটা ঢেকে নাও। বেগানা পুরুষের দিকে তাকানো হারাম যে, জানো না!
এক লোক আব্দুল্লাহ বিন উমর-কে মশা মারা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, 'এ লোকের দিকে তাকাও তোমরা। এরা আমাকে মশা মারা সম্পর্কে মাসআলা জিজ্ঞেস করে! অথচ এরাই সে লোক যারা রাসুল সাঃ এর নাতিকে হত্যা করেছে।"
এরপর ইবনুল কাইয়িম বলেন, আমার সাথেও এমন এক ঘটনা ঘটেছিল। একবার আমি ইহরাম অবস্থায় ছিলাম। এমন সময় এক বেদুইন আমার কাছে আসলো। তারা মানুষ হত্যা করা, লোকজনের সম্পদ লুটপাট করার জন্য কুখ্যাত ছিল। তারা এসে আমার কাছে মুহরিম উকুন মারতে পারবে কি না-সে মাসআলা জানতে চাইল! আশ্চর্য! তারা আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত হারাম প্রাণকে হত্যা করার মতো চরম অপরাধ করে, তারাই আবার মুহরিম অবস্থায় উকুন মারা না মারার প্রশ্ন করে! (উদ্দাতুস সাবিরিন,৫৫-৫৭)