বাদশাহ হারুন অর রশীদের ছেলের যে ঘটনা জীবন পরিবর্তন করে দিবে।

আব্দুল্লাহ ইবনু ফারাজ রহিমাহুল্লাহ বলেন, বাসায় টুকিটাকি মেরামত কাজের জন্য একবার তার একজন মেরামতকারীর প্রয়োজন পড়ে। যাকে দিয়ে তিনি সারাদিন কাজ করিয়ে মজুরি দিবেন। এমন লোক খুঁজতে তিনি বাজারে যান। সেখানে তিনি মলিন মুখ ওয়ালা একজন বালককে দেখতে পান। সে পশমি পোশাক পড়ে ছিল। তার কুর্তা কোমরের সাথে পশমের বেল্ট দিয়ে বাঁধা ছিল। তার হাতে ছিল বড় একটি বালতি আর ছিল একটি দড়ি। আব্দুল্লাহ তাকে কাজের প্রস্তাব দেন। বালক রাজি হয় এবং বলে তাকে এক দিরহাম এবং এক দানিক (১/৬ দিরহাম) মজুরি দিতে হবে। সাথে সে এও বলে সারা দিন সে কাজ করবে তবে যোহরের সালাত পড়ার জন্য যোহরের আযানের এবং আসরের জন্য আসরের আযানের পর সে কোনো কাজ করতে পারবে না।

বাদশাহ হারুন অর রশীদের ছেলের যে ঘটনা জীবন পরিবর্তন করে দিবে।

আব্দুল্লাহ তার শর্ত মেনে নেন এবং তাকে বাসায় এনে সকল কাজ বুঝিয়ে দেন। বালক একনাগাড়ে কাজ করতে লাগলো, মাঝে কোনো বিরতি নিলো না। যোহরের আযান হলে সে আব্দুল্লাহকে তার শর্তের কথা মনে করিয়ে দিল এবং সালাতের জন্য বের হয়ে গেল। সালাত শেষে সে ফিরে এসে আসরের আযান পর্যন্ত বিনা বিরতিতে কাজ করল। আসরের সালাতের পর সূর্যাস্ত পর্যন্ত সে কাজ করল। তারপর দিনের মজুরি নিয়ে সে চলে গেল।

কয়দিন পর আব্দুল্লাহর আরো কিছু মেরামতের প্রয়োজন পড়ে। তার স্ত্রী তাকে বলেন আগের বালকের মতই কাউকে যেন খুঁজে আনে, কেননা সে কাজে ছিল খুব দক্ষ, আর আচরণে ছিল সত্যবাদী। আব্দুল্লাহ আবার বাজারে যান, কিন্তু তাকে খুঁজে পাননি। তিনি বালক সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, বালক শনিবার ব্যতীত অন্য কোনো দিন কাজ করে না। আব্দুল্লাহ শনিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, এবং শনিবারে তাকে খুঁজে পেয়ে কাজের প্রস্তাব দেন। সে আগের শর্তে কাজ করতে রাজি হয়। সারাদিন কাজের পর আব্দুল্লাহ তাকে নির্ধারিত মজুরি থেকে কিছু অতিরিক্ত টাকা নেয়ার জন্য প্রস্তাব করেন। এতে সে নাখোশ হয়, এবং আব্দুল্লাহর বাসা থেকে দ্রুত বের হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ তার পিছনে দৌড়ে আসেন, আর তাকে কমপক্ষে তার নির্ধারিত টাকা নিতে অনুরোধ করেন। তখন সে নির্ধারিত টাকা নিয়ে চলে যায়।

কিছু দিন পরে আব্দুল্লাহর আরো কিছু মেরামতের প্রয়োজন দেখা দেয়। তাই আব্দুল্লাহ অপেক্ষা করেন এবং শনিবারে বাজারে যান। কিন্তু সেখানে তাকে খুঁজে পাননি। কেউ একজন তাকে ঐ বালকের কথা জানায়। সে কয়েক দিন ধরে অসুস্থ আছে। আব্দুল্লাহ তার বাসার ঠিকানা নিয়ে তাকে দেখতে যান। সে একজন বৃদ্ধার বাসায় থাকে। তিনি বাসায় গিয়ে দেখেন সে ইটের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। 'তোমার কী কিছু লাগবে?' আব্দুল্লাহ বালককে জিজ্ঞেস করেন।

'হ্যাঁ, যদি আপনি পারেন।'- বালক জবাব দেয়।

আব্দুল্লাহ বলেন, তিনি করবেন।

'যখন আমি মরে যাব,' সে বলতে লাগলো, 'আমার দড়ি বিক্রি করে দিবেন, আমার কোর্তা এবং বেল্ট ধুয়ে পরিষ্কার করে নিবেন এবং তা পড়িয়ে আমাকে কবর দিবেন। আমার কোর্তার ভিতরের পকেটে দেখবেন, সেখানে একটি আংটি আছে। তা নিজের কাছে রেখে অপেক্ষা করবেন। যখন হারুন-আল-রশিদ (তৎকালীন খলিফা) শহরে আসবেন। তখন আপনি তার কাছে গিয়ে ঐ আংটিটি দেখাবেন। মনে রাখবেন আমাকে দাফনের পরেই তাকে আংটি দেখাবেন।' আব্দুল্লাহ তার কথা মেনে নিলেন।

যুবকের মৃত্যু হলে আব্দুল্লাহ তার অন্তিম ইচ্ছা বাস্তবায়ন করলেন। খলিফা হারুনুর রশিদ যখন শহরে এলেন, আব্দুল্লাহ সাক্ষাতের জন্য তার কাছে যান। এমন স্থানে তিনি দাঁড়ান যেখান থেকে খলিফা তাকে দেখতে পারবেন। সেখানে গিয়ে তিনি আংটিটি বাতাসে নাড়ান। হারুন তাকে দেখতে পান, এবং তাকে কাছে ডাকেন। হারুন উপস্থিত সকলকে বেরিয়ে যেতে বলেন। আব্দুল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন, সে কে এবং আংটিটি তিনি কোথায় পেলেন। আব্দুল্লাহ তাকে জবাব দেন। আব্দুল্লাহ তাকে বালকের পুরো দাস্তান শুনান। বালকের কাহিনি শুনার সময় খলিফা হারুন প্রচণ্ড কাঁদেন। এত বেশি কান্না করেন যে আব্দুল্লাহ

নিজেকে অপরাধী মনে করছিলেন। খলিফাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, 'হে বিশ্বাসীদের নেতা! ঐ বালকের সাথে আপনার কী সম্পর্ক আছে?'

খলিফা বললেন, 'সে ছিল আমার পুত্র!'

'সে কেন এমনভাবে জীবন যাপন করছিল?'

'আমি খলিফার পদে আসিন হবার পূর্বে তার জন্ম হয়, খুব সুন্দরভাবে তার প্রতিপালন হয়, কুর'আন এবং বিজ্ঞানে সে বেশ শিক্ষিত ছিল। যখন আমাকে খলিফা মনোনীত করা হয়, তখন সে আমাকে ছেড়ে চলে যায় এবং দুনিয়াবী জিনিস থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে তার মায়ের খুব আদরের সন্তান ছিল, তাই তাকে দেয়ার জন্য আমি তার মা-কে এই মহামূল্যবান আংটি দিই। অনিচ্ছার সাথে সে আংটিটি গ্রহণ করে। তার মায়ের মৃত্যুর পর আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যে তার সম্পর্কে আমাকে খোঁজ জানাচ্ছেন। আপনি আজ রাতে আমাকে তার কবর জিয়ারতে নিয়ে যাবেন।'

আব্দুল্লাহ খলিফা হারুনকে সন্তানের কবর জিয়ারতে নিয়ে যায়। হারুন দীর্ঘক্ষণ সেখানে কান্না করেন, কবরের পাশে দাঁড়িয়ে অশ্রু ঝড়ান। ভোর পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন। হারুন আব্দুল্লাহকে কিছুদিন তার সাথে থাকতে অনুরোধ করেন যাতে তিনি রাতে কবর জিয়ারত করতে পারেন। আব্দুল্লাহ আগে জানত না যে সে মেরামতকারী বালক ছিল খলিফা হারুনের পুত্র। সেদিনই তিনি প্রথম এটা জানতে পারেন।

সূত্রঃ

কিতাবুত তাইবিন মিনাল মুবুক ওয়াস সালাতিন: ৩৭।

উক্ত ঘটনা থেকে আমরা যে শিক্ষা পেলাম 

এক, আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে তার জন্য কিছু কোরবানি করতে হবে।

দুই, আল্লাহর সান্নিধ্য প্রাপ্ত ব্যক্তিরা কখনো নিজের পরিচয় প্রকাশ করেন না।

তিন, দুনিয়ার প্রতি লালায়িত হ‌ওয়া যাবে না।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে উক্ত ঘটনা থেকে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করে হেদায়েতের উপর চলার তাওফীক দান করুক... আমীন।

About the author

Somadanmedia
A trusted platform of Education-Culture & News and Islamic Matters And online trip's

Post a Comment