আল্লাহ প্রদত্ত সকল বিধি-বিধান লংঘনকারী, ঈমান আমল বিধ্বংসকারী, ইসলামী জীবন ধারাকে ধ্বংসকারী মতবাদ ট্রান্সজেন্ডারের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনে নেই, কেননা এই কুফরি মতবাদ অচিরেই বিভিন্ন দেশে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বৈধতা পেয়েছে। আমাদের দেশেও অচিরেই এই মতবাদের আবির্ভাব ঘটতে যাচ্ছে। তাই চলুন আমরা এই মতবাদ সম্পর্কে জানি এবং যেন আমাদের দেশে কোনভাবেই এই মতবাদ প্রচার-প্রসার না হয় সে সম্পর্কে জাতিকে জানাই।
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ কি?
ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দ টি সর্বপ্রথম ১৯৬৫ সালে ব্যবহারিত হয়। ট্র্যান্সজেন্ডার (transgenderism) রুপান্তর কামিতা। অনেক আবার জেন্ডার আইডেন্টিটি বা লিঙ্গ পরিচয় মতবাদও বলে থাকেন। কেতাবি ভাবে ট্র্যান্সজেন্ডার শব্দ দিয়ে এমন কোন ব্যক্তিকে বুঝানো হয় যার আত্মপরিচয়ের উপলব্ধি তার শরীরের সাথে মিলে না। সহজে বলতে গেলে যার শরীর পুরুষের কিন্তু সে নিজেকে নারী মনে করে কিংবা যার দেহ নারীর কিন্তু সে নিজেকে পুরুষ মনে করে।
এই মতবাদ বলে কোন পুরুষ যদি নিজেকে নারী মনে করে তাহলে সে একজন নারী। সমাজ ও আইন তাকে নারী হিসেবে মেনে নিবে। যদিও সে পুরুষ পরিপূর্ণ সুস্থ সবল হোক, কয়েক বাচ্চার পিতা হোক।
এই মতবাদ বলে যদি কোন নারী নিজেকে পুরুষ মনে করে তাহলে সে একজন পুরুষ। যদিও তার মাসিক হয়, বাচ্চা ধারণ করে তাহলেও সে একজন পুরুষ। এটা ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের ভ্রান্তের কোন প্রমাণ না। ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের মতে পুরুষও বাচ্চা দিতে পারে।
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের মূল বক্তব্য
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের মূল বক্তব্য হলো একজন মানুষ পুরুষ নাকি নারী তার সাথে দেহের কোন সম্পর্ক নাই। মানুষের দেহ তার পরিচয় নির্ধারণ করে না। পরিচয় নির্ভর করে মানুষের মনে উপর। একজন মানুষ নিজে যা মনে করে সেটিই তার পরিচয়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় আমেরিকার প্রাইমারি স্কুলের আই য়্যাম জ্যায ( I am jazz) বইতে বলা হয়েছে আমার মস্তিষ্ক মেয়েদের কিন্তু শরীর ছেলেদের, এটাকে ট্র্যান্সজেন্ডার বলে, আমি জন্ম থেকেই এমন।
প্রাইমারি স্কুলের আরেক বই It feels good to be yourself এ বলা হয়েছে, দেখ তোমরা যখন জন্ম গ্রহণ করেছিলে তখন নিজের অনুভূতি অন্যকে জানাতে পারতেনা। তোমার আসেপাশে মানুষেরা তোমাকে দেখে একটা অনুমান করে নিয়ে ছিল, সেটা ঠিকও হতে পারে ভুলও হতে পারে। আমি জানি তোমারা আমাকে ছেলে মনে কর আসলে আমার মনে হয় আমি একটা মেয়ে।
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ কখন আবিষ্কার হয়।
ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ কীভাবে আবিষ্কার হলো, কীভাবে আজকের পৃথিবীতে এতো শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছলো সে আলোচনা অনেক লম্বা। এর সাথে জড়িত আছে পাশ্চাত্যের দর্শন, ব্যক্তিস্বাধীনতা, ব্যক্তি পরিচয় ও মানবাধিকারের ধারণাসহ আরো অনেক কিছু। তবে ট্যান্সজেন্ডারবাদের উত্থানের পেছনে সরাসরি সম্পর্ক খুঁজতে গেলে নিচের তালিকা পাওয়া যাবে
১, পাশ্চাত্যের নারীবাদী আন্দোলন,
বিশেষ করে নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় ধারা (Third wave feminism), যা নারীত্ব ও পুরুষের ধারণাকে আক্রমণ করেছে।
২, অ্যামেরিকাতে হওয়া 'সমকামী অধিকার আন্দোলন', যার মাধ্যমে সমকামিতাসহ নানা বিকৃত যৌনতা এবং 'সমকামী বিয়ে' আইনী বৈধতা পেয়েছে।
৩, ষাটের দশকে অ্যামেরিকায় ঘটা 'যৌন বিপ্লব', যা যৌনতার ব্যাপারে সব ধরনের মূল্যবোধ মুছে ফেলেছে।
এ তিনের মিশ্রণে তৈরি হওয়া জেন্ডার আইডেন্টিটি (Gender Identity) মতবাদ।
৪, চিকিৎসাশাস্ত্র, চিকিৎসক ও ফার্মাসিউটিকাল ইন্ডাস্ট্রির একটি অংশ।
৫, সমকামিতা ও অন্যান্য বিকৃতির স্বাভাবিকীকরণে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করা দাতারা।
এই সম্পর্কে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়
ষাটের দশক থেকে শুরু করে প্রায় ৫ দশক ধরে অ্যামেরিকাতে চলে সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার আন্দোলন। মিডিয়া, অ্যাক্টিভিজম, আইন-আদালতসহ নানাভাবে এ আন্দোলনের চেষ্টা চালিয়ে যায় তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের। বিকৃত যৌনাচারে আসক্ত লোকদের উপস্থিত করা হয় 'সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী' আর 'সংখ্যালঘু' হিসেবে। বিকৃত যৌনতার বৈধতার দাবি তোলা হয় মানবাধিকারের নামে।
পঞ্চাশ বছর ধরে গড়ে ওঠে দাতা, এনজিও, অ্যাক্টিভিস্ট, মিডিয়া, উকিল, রাজনীতিবিদ আর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর এক বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। শেষমেষ ২০১৫ সাল নাগাদ সমকামিতা এবং 'সমকামী বিয়ে' পশ্চিমা বিশ্বে বৈধতা পেয়ে যায়। আর তার ঠিক পরপর, পাঁচ দশক ধরে গড়ে ওঠা এই নেটওয়ার্ক মনোযোগ দেয় ট্রান্সজেন্ডারবাদের প্রচার ও প্রসারে। বলা চলে তখন থেকেই ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের সূচনা হয়।
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ কিভাবে বিস্তার লাভ করে।
উপর উল্লেখিত নেটওয়ার্কের একদম উপরে আছে বিশাল সব দাতা। যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এইসব বিকৃতির প্রসারে খরচ করে চলছে। তাদের টাকাগুলো দিয়ে গড়ে উঠছে নানান এনজিও। এনজিওগুলো রাজনীতিবিদদের কাছে দেনদরবার করছে, নানা ইস্যুতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে, তৈরি করছে অসংখ্য অ্যাক্টিভিস্ট যারা ছড়িয়ে পড়ছে অনলাইন ও অফলাইন প্রচারণায়। একইসাথে এই দাতারা বড় বড় রাজনীতিবিদের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের পেছনেও টাকা ঢালছে, সেই সাথে শর্ত জুড়ে দিচ্ছে, ক্ষমতায় গেলে সমকামিতা আর ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের প্রসারে কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে এনজিওগুলো আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে, তারা উকিলদের দিয়ে খসড়া আইন বানাচ্ছে, তারপর নিজেদের নেটওয়ার্কের প্রভাব খাটিয়ে সেগুলো পাশ করিয়ে আনছে বিধানসভা থেকে। এভাবে পশ্চিমা দেশগুলোতে বিকৃত যৌনতা বৈধ হয়ে যাচ্ছে।
নিজ দেশে বৈধতা দেওয়ার পর শক্তিশালী পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ব্যবহার করে সারা বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারের নামে বিকৃত যৌনতাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ঐ যে বড় বড় দাতাদের কথা বললাম, তাদের টাকায় গড়ে উঠছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এনজিও। এসব এনজিওগুলোর অনেকে 'মানবাধিকার' আর সামাজিক ইস্যুতে খোদ জাতিসংঘের উপদেষ্টা বনে বসে আছে। এইসব এনজিও এবং শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্বগুলোর ক্রমাগত সুপারিশের ফলে একসময় জাতিসংঘও বিকৃত যৌন আচরণকে মানবাধিকার বলে স্বীকৃতি দিচ্ছে। যার ফলে অ্যামেরিকান সরকার থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা আজ বিশ্বব্যাপী ট্র্যান্সজেন্ডারবাদ এবং সমকামিতার স্বাভাবিকীকরণে কাজ করছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ২০২১ এর জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন এক মেমোরেন্ডাম স্বাক্ষর করে।
এতে বলা হয়, ভিন দেশে কাজ করা মার্কিন সংস্থাগুলো যেন এলজিবিটিকিউআই (সমকামিতা, ট্র্যান্সজেন্ডার ও অন্যান্য বিকৃত যৌনতার স্বাভাবিকীকরণের আন্দোলন) ইস্যুতে বিদেশী সরকারগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য সব ধরনের কূটনৈতিক এবং সহায়তামূলক উপকরণগুলো কাজে লাগানোর কথা বিবেচনা করে। পাশাপাশি যথাযথ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, ভিসা রেস্ট্রিকশান এবং অন্যান্য অ্যাকশনও বিবেচনা করে। অর্থাৎ কোন দেশ যদি সমকামিতা এবং ট্রান্সজেন্ডারবাদের স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় তাহলে মার্কিন সরকার তাদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে পারে, তাদেরকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে। তাদের উপর আরোপ করতে পারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কিংবা ভিসা রেস্ট্রিকশান। সম্প্রতি সমকামিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় উগান্ডার বিরুদ্ধে স্যাংশান দেওয়া হয়েছে।
ইসলামে ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের হুকুম
উপসংহার
ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ সম্পর্কে আলোচনা চালু থাকবে ইনশাআল্লাহ। প্রিয় পাঠক এই সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে আসিফ আদনানের লেখা ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ বইটি পড়তে পারেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক।