আমাদের সমাজে হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের ধারণা আছে। ট্র্যান্সজেন্ডারবাদের কথা শুনলে অধিকাংশ মানুষ মনে করেন এটা হয়তো হিজড়াদের অধিকার নিয়ে কোনো আন্দোলন। কিন্তু এ দুটো জিনিস একেবারেই আলাদা। আসুন পুরো ব্যাপারটা ভেঙে ভেঙে দেখি, ঠিক কোন কোন জায়গাতে আমরা ভুল করেছি।
হিজড়া এবং ট্র্যান্সজেন্ডারের মৌলিক পার্থক্য
মানুষ হয় পুরুষ অথবা নারী। যাদের দেহ শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা পুরুষ, যাদের দেহ ডিম্বাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি তারা নারী। এটা শুধু বাহ্যিক 'যন্ত্রপাতি'র বিষয় না। পুরো প্রজননব্যবস্থার বিষয়।
মানবজাতির মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক কিছু মানুষ আছেন যাদের প্রজননব্যবস্থা এবং যৌন বিকাশের ত্রুটি থাকে। বাহ্যিকভাবে তাদের দেহে জন্মগতভাবে নারী ও পুরুষ উভয়ের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রে। এধরনের মানুষকে বোঝাতে যে শব্দটা ব্যবহৃত হয় তা হলো ইন্টারসেক্স (Intersex) বা আন্তঃলিঙ্গ। বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ হিজড়া বলতে মূলত ইন্টারসেক্স বা আন্তলিঙ্গ মানুষদের বুঝিয়ে থাকে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী জনসংখ্যার মাত্র ০.০১৮% মানুষ ইন্টারসেক্স বা হিজড়া হন। ৯৯.৯৮২% মানুষ স্বাভাবিক শরীর নিয়ে জন্ম নেন।
যে বিষয়টা আমাদের বোঝা দরকার তা হলো, ইন্টারসেক্স বা আন্তলিঙ্গ মানুষরা তৃতীয় কোনো লিঙ্গ না বা দুটোর মাঝামাঝি কিছুও না। তারাও নারী অথবা পুরুষ, তবে তাদের যৌন অঙ্গ, গঠন বা জিনগত কিছু ত্রুটি থাকে। যে কারণে এ ধরনের সমস্যাকে ডিসঅর্ডার অফ সেক্স ডেভেলপমেন্ট (ডিএসডি)-ও বলা হয়।
যেমন, ধরা যাক একটি শিশুকে জন্মের সময় বাহ্যিকভাবে মেয়ে মনে হয়েছে, সেভাবেই সে বড় হয়েছে। কিন্তু বয়ঃসন্ধির সময় দেখা গেল তার মাসিক হচ্ছে না। তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হলো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেল তার জরায়ু নেই, ফ্যালোপিয়ান টিউব নেই; বরং শরীরের ভেতরে অণ্ডকোষ আছে। তার শরীর পুরুষের হরমোন তৈরি করছে, তার শরীর শুক্রাণু উৎপাদনের জন্য তৈরি। ইনি একজন ইন্টারসেক্স পুরুষ, যার শরীরে বাহ্যিকভাবে নারীসুলভ কিছু চিহ্ন আছে।
অন্যদিকে নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার দাবি করা লোকেরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আন্তলিঙ্গ বা ইন্টারসেক্স না। তাদের কোনো ধরনের ডিএসডি (ডিসঅর্ডার অফ সেক্স ডেভেলপমেন্ট) নেই। তাদের জন্ম হয়েছে সুস্থ এবং স্বাভাবিক যৌনাঙ্গ নিয়ে।
যারা নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার নারী দাবি করে তারা পুরুষ। তাদের অণ্ডকোষ আছে, পুরুষাঙ্গ আছে, তাদের শরীরে আছে এক্সওয়াই ক্রোমোসোম। নিজেদের যারা ট্র্যান্সজেন্ডার পুরুষ বলছে তারা আসলে নারী। তাদের জন্ম জরায়ু, ডিম্বাশয়, যোনী এবং ফ্যালোপিয়ান টিউব নিয়ে। তাদের দেহে আছে এক্সএক্স ক্রোমোসোম। যারা সত্যিকার অর্থে আন্তলিঙ্গ তাদের খুব অল্প সংখ্যকই নিজেদের ট্র্যান্সজেন্ডার বলে দাবি করে।
এখন আমরা এখন একত্রে ট্রান্সজেন্ডার ও হিজড়াদের পার্থক্য গুলো উল্লেখ করবো। যার মাধ্যমে আমাদের সঠিক জ্ঞান অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ।
হিজড়া আর নিষিদ্ধ ট্রান্সজেন্ডারের মধ্যে ১০টি মৌলিক পার্থক্য
১. হিজড়া জন্মগত ত্রুটি। ল্যাবটেস্ট করে জেনেথিক সমস্যার বিষয়টি প্রমাণ করা যায়।
২. ট্রান্সজেন্ডার এটি মানসিক অবস্থা। যার সাথে জন্মগত লিঙ্গের কোনো সম্পর্ক নেই। ল্যাবটেস্ট করে প্রমাণ করা যায় না। স্বঘোষিত পরিচয় (self-identified) ধারণ করে। একটি ছেলে বা মেয়ে নিজেকে 'ভুল দেহে' আটকা পড়েছে মনে করে।
৩. হিজড়া হওয়া খুবই অস্বাভাবিক ও বিরল ঘটনা। প্রতি ৫ হাজার জনে একজন হিজড়া হতে পারে।
৪. হিজড়া হওয়া একটি শিশু অস্পষ্ট বাহ্যিক প্রজনন অংগ নিয়ে জন্মাতে পারে। কারোর ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি, এমনকি ২০/২৫ বছর বয়সেও শারীরিক পরিবর্তন হতে পারে।
৫. ট্রান্সজেন্ডার হওয়ার ক্ষেত্রে হরমোন বা সার্জারি করে ট্রান্সজেন্ডার হলো কী না, তা মুখ্য নয়। বরং এই আইডেন্টিটি প্রকাশিত হতে পারে নাম পরিবর্তন করে। যেমন পুরুষ থেকে নারীর নাম ধারণ করে। কিংবা নারী থেকে পুরুষ নাম ধারণ করে। পোশাক পরিবর্তন, মেকআপ করা, নেইল পলিস, চুল মেয়েদের মতো লম্বা করে রাখে।
৬. হিজড়াদের কেউ কেউ অবিকল মেয়ে হয়ে বড় হতে থাকে। কিন্তু বড় হওয়ার পর এমনকি বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন দেখা যায় তার ঋতুস্রাব হচ্ছে না, তখন বোঝা যায় আসলে সে লিঙ্গ প্রতিবন্ধী হিজড়া।
৭. সার্জারি করে ট্রান্সজেন্ডার হয়ে জড়ায় বানানো যায় না। আবার কার্যকরি পুরুষাঙ্গও তৈরি করা যায় না, যার দ্বারা প্রজনন ক্ষমতা তৈরি হয়।
৮. হিজড়ারা জন্মগতভাবেই সন্তান জন্ম দিতে পারে না। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডাররা সার্জারির আগে সন্তান জন্মদানের আল্লাহ প্রদত্ত যোগ্যতা রাখে।
৯. গবেষণায় দেখা গেছে ২০% ট্রান্সজেন্ডার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট করে বাহ্যিক নারী বা পুরুষের মতো কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করলেও বাস্তবে ১৮% ট্রান্স নারীর পুরুষাঙ্গ থাকে। তেমনিভাবে ট্রান্স পুরুষের যোনি থাকে।
১০. ট্রান্সজেন্ডাররা মূলত সমকামি হয়ে থাকে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে হিজড়া এবং ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদ এক নয়। যদি কোন সময় বাংলাদেশ কিংবা অন্য কোন দেশে এই ট্র্যান্সজেন্ডার মতবাদের আওয়াজ উঠে তখন সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করতে যেন কোন বিলম্ব না হয়। রব্বে কারীম আমাদের কে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার তাওফীক দান করুক।