দৃষ্টি সংযত রাখার ২২টি উপকারিতা

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দৃষ্টি সংযত রাখার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে। তম্মদ্যে দৃষ্টি সংযত রাখার ২২টি উপকারিতা

আল্লাহ তাআলার মহা অনুগ্রহ সমূহ হতে অন্যতম দৃষ্টি শক্তি। দৃষ্টি শক্তি আল্লাহর প্রদত্ত কত বড় নিয়ামত তা অন্ধের দিকে লক্ষ্য করলেই অনুধাবন করা যায়। এই দৃষ্টি শক্তি যেমন আল্লাহর বিশেষ কৃপা তেমনি তার জন্য রয়েছে অনেক বিধি নিষেধ। এই নিয়ম কানুন মেনে চললে রয়েছে অনেক ফজিলত ও উপকারিতা। আজ সমাধান মিডিয়া এই উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করবে ইনশাল্লাহ। 

22 Benefits of Keeping Eyesight

দৃষ্টিসংযম কী?

‘দৃষ্টিসংযম হলো: ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী যা দেখা হারাম, তা থেকে দৃষ্টি সংযত রাখা, যা দেখা হালাল, কেবল সেদিকেই দৃষ্টিপাত করা। হারাম সবকিছু উপেক্ষা করে যাওয়ার ব্যাপারেও এই হুকুম প্রযোজ্য। কিন্তু এরপরও যদি আকস্মিক এবং অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হারাম কিছু চোখে পড়েই যায়, তবে তৎক্ষণাৎ চোখ ফিরিয়ে নিতে হবে।'

আমরা জানি, জিনা-ব্যভিচারের মতো জঘন্য ও অশ্লীল কাজের সূত্রপাত ঘটে অসংযত দৃষ্টিপাত থেকে৷ কিন্তু এই ছোট্ট, অথচ ভয়ংকর রোগে আজ পুরো জাতি আক্রান্ত। অধিকাংশ মুসলিম আজ অশ্লীলতা ও বেহায়াপনায় লিপ্ত।

অথচ, এই নোংরামো ও নির্লজ্জতার কারণে চারদিকে শত্রুতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকছে, অবৈধ সন্তান জন্ম নিচ্ছে, বংশ-পরম্পরা নষ্ট হচ্ছে; কিন্তু সে খবর কে রাখে? এই বিষয় গুলো সামনে রেখে আজ আমরা দৃষ্টি সংযত রাখার উপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করব। সুতরাং যখন তার উপকারিতা সম্পর্কে জানবো তখন তার অপকারিতা সম্পর্কেও জ্ঞাত হয়ে যাব।

দৃষ্টি সংযত রাখার উপকারিতা সমূহ

আল্লামা ইবনুল কাইয়িম রাহিমাহুল্লাহ বলেন, দৃষ্টি সংযত রাখার মধ্যে অনেক উপকারিতা রয়েছে।

১. সংযতদৃষ্টি  দুনিয়া ও আখেরাতে শান্তি 

আল্লাহ তাআলা বান্দাকে দৃষ্টি সংযত রাখতে আদেশ করেছেন। আর আল্লাহর আদেশ মান্য করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইহকাল ও পরকালের যাবতীয় সুখ ও শান্তি। দুনিয়া ও আখেরাতের বিবেচনায় বান্দার জন্য আল্লাহর হুকুম মেনের চলার চেয়ে কল্যাণকর আর কিছু নেই। তারচেয়ে দুর্ভাগা আর কে হতে পারে, যে আল্লাহর আদেশ অমান্য করে নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে আনে।

২. সংযতদৃষ্টি ধংস থেকে রক্ষা 

যে বিষাক্ত তীর মানব-মনে বিদ্ধ হয়ে বিষক্রিয়া ছড়ায় এবং মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়—দৃষ্টিসংযম সেই বিষাক্ত তীরকে প্রতিরোধ করে।

৩. সংযতদৃষ্টি আল্লাহর প্রতি ভালবাসা তৈরি 

 নজরের হেফাজত মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও একাগ্রতা তৈরি করে। পক্ষান্তরে যত্রতত্র দৃষ্টিপাত অন্তরকে বিক্ষিপ্ত করে, হৃদয়কে আল্লাহবিমুখ করে। আর বান্দার জন্য আল্লাহবিমুখ হওয়ার চেয়ে ভয়ংকর আর কিছু নেই। এর দ্বারা বান্দা ও তার প্রতিপালকের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। যা তার জন্য ধ্বংসাত্মক।

৪. সংযতদৃষ্টি মনকে প্রফুল্ল রাখার মাধ্যম

 নজরের হেফাজত মানুষের অন্তরাত্মাকে শক্তিশালী করে, মনকে প্রফুল্ল রাখে। এর উল্টোটি হৃদয়কে দুর্বল করে, ব্যথিত রাখে।

৫. সংযত দৃষ্টি হৃদয় কে আলোকিত করে 

 অবনত দৃষ্টি হৃদয়কে আলোকিত করে। আর অবাধ দৃষ্টি অন্তরকে কলুষিত করে। এ কারণেই আল্লাহ তাআলা দৃষ্টিসংযম সম্পর্কিত আয়াত :(আপনি মুমিনদের বলুন, যেন তারা দৃষ্টি সংযত রাখে এবং যৌনাঙ্গ হেফাজত করে।)-এর (আল্লাহ পরপর নুর সম্পর্কিত আয়াত :

নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের জ্যোতি, তাঁর জ্যোতির উদাহরণ যেন একটি কুলঙ্গি, যাতে আছে একটি প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচপাত্রে স্থাপিত, কাঁচপাত্রটি উজ্জ্বল নক্ষত্ৰ সদৃশ।) এনেছেন। অর্থাৎ, মুমিন বান্দা যখন আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে তখন তার কলবে আল্লাহর নুরের প্রতিফলন ঘটে। আর এমন নুরান্বিত অন্তরসম্পন্ন ব্যক্তির দিকে যাবতীয় কল্যাণ ধাবিত হতে থাকে। অপরদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন কলবের অধিকারীকে অনিষ্ট ও অকল্যাণের মেঘমালা বেষ্টন করে ফেলে৷ মূলত ভ্রান্ত-পথে-চলা এবং প্রবৃত্তির-অনুসরণ করা মানুষের অন্তর থেকে আল্লাহর নুর দূরীভূত করে। আর নুর- বঞ্চিত একজন মানুষ হয় নিকষকালো অন্ধকার রাতের অন্ধের মতো।

৬. সংযতদৃষ্টি সত্যিকারের অনন্ত দৃষ্টি অর্জন 

 দৃষ্টিসংযম মানুষকে সত্যিকারের অন্তর্দৃষ্টি দান করে। এর দ্বারা সে হক-বাতিল ও সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে৷ শাইখ শুজা আল-কিরমানি বলতেন, 'যে ব্যক্তি সুন্নাহর অনুসরণ করবে এবং হালাল খাদ্য ভক্ষণ করবে, অবশ্যই সে অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী হবে।”

বান্দা যে আমল করে আল্লাহ তাআলা তাকে বিনিময় দান করেন। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় কেউ কিছু ত্যাগ করলে, আল্লাহ তাকে তার ত্যাগের চেয়ে উত্তম কিছু দান করবেন। তাই কেউ যদি আল্লাহর ঘোষিত নিষিদ্ধ বিষয়াবলি থেকে নিজের নজর হেফাজত করে, এর বিনিময়ে আল্লাহ তার অন্তর্চক্ষুকে জ্যোতির্ময় করে দেন। তার জন্য ইলম, ঈমান, মারেফাতের দরোজা খুলে দেন।

৭. দৃষ্টি সংযম অন্তরের শক্তি ও সাহস তৈরি করে।

 দৃষ্টিসংযম মানব-মনে দৃঢ়তা, অবিচলতা, শক্তি ও সাহস জোগায়। এগুণের অধিকারী ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা যেমন সাহায্য-সহযোগিতা করেন, তেমনি শক্তি-সক্ষমতাও দান করেন। বর্ণিত আছে, 'যে ব্যক্তি প্রবৃত্তির বিরুদ্ধাচারণ করে চলে, শয়তান তার ছায়াকেও ভয় করে। এর ঠিক উল্টোটি দেখা যাবে প্রবৃত্তির অনুসারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে। পদে পদে সে লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, অপদস্ত হবে। কারণ, অবাধ্য কাউকে আল্লাহ তাআলা উল্লিখিত নিয়ামত দান করেন না। ঠিক যেমনটি বলেছেন হজরত হাসান বসরি রাহিমাহুল্লাহ, ‘পাপিষ্ঠ ব্যক্তিরা শান-শওকতের সাথে গাড়ি-ঘোড়ায় ভ্রমণ করলেও পাপ থেকে তারা মুক্তি পায় না বরং পাপের অপমান তাদের ঘাড়েই থাকে। পাপীরা দুনিয়ার বুকে যতই মর্যাদাবান হোক না কেন, আল্লাহ তাদেরকে অপমান করবেনই করবেন।'

বস্তুত, আল্লাহ তাআলা যেমন সম্মানকে আনুগত্যের আলামাত করেছেন, তেমনটি অসম্মানকে অবাধ্যতার চিহ্ন করেছেন।

৮. সংযত দৃষ্টি শয়তানের জন্য হৃদয়ের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে

নজরের হেফাজত শয়তানের জন্য হৃদয়ের প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে দেয়। কারণ, শয়তান মূলত অসংযত দৃষ্টির মাধ্যমেই অন্তরের প্রবেশ করে। অতঃপর সেখানে যাচ্ছেতাই করে বেড়ায়। সারা দিন যা দেখা হয়েছে, দিনশেষে মনসপটে সেসবের চিত্র ভাসিয়ে তোলে। এগুলোকে সে আরও সুশোভিত, আরও আকর্ষণীয় করে পেশ করে। এরপর সেটাকে কেন্দ্র করে মনের ভেতর ঘূর্ণিপাক সৃষ্টি করে। একটু একটু করে তা দিতে থাকে আবেগ-অনুভূতিতে। একপর্যায়ে হৃদয়-মাঝে জ্বেলে দেয় যৌবনের আগুন৷ পাপাচার আর অনাচার হয় তার ইন্ধন। আর এসবকিছুর অন্যতম কারণ সেই অবৈধ দর্শন। অতঃপর এ আগুন একসময় দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে, আর তাতে জ্বলতে থাকে পাপাচারীর অন্তরাত্মা। তার দীর্ঘশ্বাস ও আফসোস সে প্রজ্বলনে যোগ করে ভিন্ন মাত্রা। পরিশেষে তার অবস্থা দাঁড়ায়—জ্বলন্ত চুলার মধ্যখানে রাখা এমন বকরির মতো, যা খুব আয়োজন করে ভুনা করা হচ্ছে। আর এজন্যই বারজাখের জীবনে প্রবৃত্তির অনুগামী এবং হারাম দৃশ্যে দৃষ্টিপাতকারীদের শাস্তি হবে এমন যে,তাদেরকে একত্রিত করে চুলা সদৃশ একটি আগুনের গর্তে ফেলে রাখা হবে।'

৯. সংযত দৃষ্টি মানসিক অস্থিরতা থেকে রক্ষা করে।

চোখ হেফাজতে থাকলে নিজের জন্য কল্যাণকর বিষয়- আশয় নিয়ে ভাবার সুযোগ তৈরি হয়। পক্ষান্তরে অসংযত দৃষ্টিপাত একরকম মানসিক অস্থিরতা তৈরি করে; সবকিছু গুরুত্বহীন করে তোলে। এমনকি আল্লাহর স্মরণ-বিমুখ করে প্রবৃত্তির অনুসরণে লিপ্ত করে।

১০. সংযত দৃষ্টি কলব কে সুস্থ রাখে 

চোখ ও অন্তরের মাঝে এক নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগব্যবস্থা বিদ্যমান। সারাক্ষণ চলে একে-অপরের মাঝে তথ্যের আদান- প্রদান। এ-কারণে একটির সংশোধন অপরটিকে সংশোধিত করে। আবার একটির ত্রুটি অপরটিকে ত্রুটিযুক্ত করে৷ অর্থাৎ, কলব নষ্ট হলে, নজর নষ্ট হয়ে যায়। আবার নজর নষ্ট হলে, কলব নষ্ট হয়ে যায়। একই কথা ভালো হওয়ার ক্ষেত্রেও।

১১. দৃষ্টিসংযম বান্দাকে ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করায়।

 কেননা, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য ত্যাগ করে, তাকে আল্লাহ তার ত্যাগের চেয়ে অনেক বড় প্রতিদান দেন৷ কারণ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে ব্যক্তি আল্লাহর দিকে একপা অগ্রসর হয় আল্লাহ তাআলা তার দিকে দুই পা অগ্রসর হন। যদি হেঁটে অগ্রসর হয় তাহলে আল্লাহ তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হন, কেউ যদি তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হয় তাহলে তিনি তার দিকে আরো বেশি গতিতে এগিয়ে আসেন।

১২.সংযত দৃষ্টি ইলম অর্জনের সহায়ক 

 সংযত দৃষ্টি ইলম অর্জনের ক্ষেত্রেও অনেক বড় সহায়ক। কেননা, আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া ইলম অর্জন সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, আল্লাহ তোমাদের ইলম দান করবেন। [সুরা বাকারা, আয়াত : ২৮২]

১৩. নজরের হেফাজত বান্দাকে জাহান্নামের অতল গহ্বরে নিপতিত হওয়া থেকে হেফাজত করতে পারে।

১৪. সংযত দৃষ্টি মানুষের দেহমনে শান্তি ও স্বস্তি এনে দেয়।

১৫. গুনাহ থেকে মুক্ত রাখে, বিপদাপদ থেকে দূরে রাখে।

১৬. এই গুণে গুণান্বিত একটি সমাজকে শান্তি ও প্রীতির সমাজে রূপান্তরিত করে।

১৭. সমাজে জিনা-ব্যভিচার ছড়িয়ে না পড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

১৮. শয়তান ও তার দোসর বড় ক্ষতি করে,মানুষকে গুনাহমুক্ত রাখে।

১৯. দৃষ্টিসংযম আমার-আপনার জন্য বিভিন্ন নিয়ামত সংরক্ষণে রাখবে। যেমন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহর (হুকুমের করবেন।হেফাজত করো, তিনি তোমাকে হেফাজত করবেন। (তিরমিযি হাদিস নং ২৫১৬)

২০. সংযত নজর হলো জান্নাতি হুরদের মোহর।

২১. আমি এই আকাঙ্ক্ষা করি যে, নজরের হেফাজতকারী প্রত্যেককে আল্লাহ তাআলা তাঁর সাক্ষাৎ লাভের নিয়ামত দান করবেন।

২২. সংযত দৃষ্টি স্বরণ শক্তি বৃদ্ধি করে

অসংযত দৃষ্টি ব্রেইনের মধ্যে রাখাপ প্রভাব সৃষ্টি করার কারণে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্জক্ষমতা হ্রাস করে। আর যদি দৃষ্টি সংযত থাকে তাহলে মানব মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্জক্ষমতা ঠিক থাকে। এতে করে স্বরণ শক্তি বৃদ্ধি পায়।

উপসংহার

উপরোক্ত আলোচনার উদ্দেশ্য হলো দৃষ্টি সংযত বা নজর হেফাজত রাখার উপকারিতা সম্পর্কে জেনে চোখের গুনাহ থেকে বিরত থাকে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জন করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কাছে এই প্রত্যাশা করি তিনি যেন আমাদের কে সকল প্রকার গুনাহের কাজ থেকে হেফাজত করেন।

About the author

Somadanmedia
A trusted platform of Education-Culture & News and Islamic Matters And online trip's

إرسال تعليق