বর্গা অর্থ ভাগ,ফসল এবং ফলের বর্গাচাষের বা ভাগেচাষের প্রক্রিয়া বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত একটি ব্যবস্থা। কিছু মানুষ অন্যের জমি বা বাগান বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে নিজের জীবন পরিচালনা করে থাকে। জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করার কিছু মাসয়ালা নিয়ে আলোচনা করবো।যদি আপনি জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ এর বিধি-বিধান জানতে চান তাহলে এ আর্টিকেলটি আপনার জন্য।
বর্গাচাষের পরিচয়
কোন ব্যক্তি কাউকে একটি খালি জমি দিয়ে বলল “এ জমিটি তুমি চাষাবাদ কর, এর উৎপাদিত ফসল যা হবে আমরা তা ওমুক হার অনুযায়ী (একটি নির্দিষ্ট হার অনুযায়ী) বন্টন করে নেব।" ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায় এরূপ চুক্তিকে মুযারাআত বা বর্গাচাষ বলে, এরূপ চুক্তি করা জায়েয।
এক ব্যক্তি একটি ফসলের বাগান করেছে তারপরে সে অন্য একজনকে বলল, তুমি এ বাগানে পানি দাও এবং পরিচর্যা কর এর যা ফসল উৎপন্ন হবে তা আমরা এ বৎসর অথবা দশ বৎসর অথবা বারো বৎসর পর্যন্ত অর্ধেক অথবা এবং এক তৃতীয়াংশ হিসাবে যা হয় তা ভাগ করে নেবো । এরূপ চুক্তিকে ফিকাহ শাস্ত্রের পরিভাষায় মুসাকাত বা বাগানের ফলের বর্গা বলে। এরূপ চুক্তি করা জায়েয।
মুযারাআত বা বর্গাচাষ জায়েয হওয়ার জন্য কতিপয় শর্ত
- জমিটি অবশ্যই চাষের উপযোগী হতে হবে ।
- জমির মালিক এবং বর্গাদার প্রাপ্তবয়স্ক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে
- চাষাবাদের সময়সীমা উল্লেখ করতে হবে ।
- বীজ কার পক্ষ থেকে দেয়া হবে তা জানা থাকতে হবে
- কোন জাতীয় ফসল চাষ করা হবে তা অবশ্যই নির্ধারণ করা হবে।
- উৎপাদিত ফসলের কত অংশ বর্গাদার পাবে তাও জানা থাকতে হবে ।
- যে জমিতে ফসল ফলাবে তা সম্পূর্ণ খালি করে বর্গাদারকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
- উৎপাদিত ফসলে বর্গাদার ও জমির মালিক উভয়ে অংশিদার থাকবে।
- জমি ও বীজ এক পক্ষের হওয়া এবং গরু ও শ্রম অপর পক্ষের হওয়া অথবা শুধু যমীন এক পক্ষের হওয়া এবং বাকী উপকরণগুলো অপর পক্ষের হওয়া।
সুতরাং উল্লেখিত শর্তসমূহ থেকে কোন একটি শর্ত অবৰ্তমান থাকলে মুযারাআত বা বর্গাচাষ চুক্তি বাতিল বলে গণ্য হবে ।
বাতিল বর্গাচাষের বিধান
কোন কারণে মুযারাআত বা বর্গাচাষ বাতিল হয়ে গেলে উক্ত চুক্তির ভিত্তিতে উৎপাদিত ফসলের মালিক হবে বীজদাতা (চাই সে বর্গাদার হোক অথবা জমির মালিক) এখন দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি জমির মালিক হয় তাহলে সে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী জমির ভাড়া পাবে। আর বর্গাদার হলে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী পারিশ্রমিক পাবে, তবে এই পারিশ্রমিক কিংবা ভাড়া তাদের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের বেশী হতে পারবে না ।
মুযারাআতের চুক্তি সম্পাদনের পর শর্তানুযায়ী কাজ করতে যদি কেউ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে তাহলে চুক্তি বহাল রাখার ব্যাপারে তাকে বাধ্য করা যাবে । তবে বীজদাতা অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তাকে বাধ্য করা যাবে না।
মুযারাআত চুক্তি সম্পাদনকারীর কোন একজন মারা গেলে চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে ।
ফসল এখনও পারে নাই অথচ ধার্যকৃত সময়সীমা অতিবাহিত হয়ে গেছে, তাহলে ফসল পাকার অতিরিক্ত দিনের জন্য বর্গাদারকে তার যমীনের ভাড়া পরিশোধ করে দিতে হবে।
অনেক অঞ্চলে বর্গা চাষের জমির উৎপাদিত ফসল চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন করা হয়। কিন্তু চুক্তির বহির্ভূত শস্য যেমন বজরা ইত্যাদি যা এই যমীনে উৎপন্ন হয় সেগুলো কোন বণ্টন করা হয় না বরং জমির বিঘা হিসাবে বর্গাদারের নিকট হতে তার কর বা ভাড়া আদায় করা হয়। আসলে তা বর্গাচাষের চুক্তি বহির্ভূত হওয়ার কারণে না জায়েয বলেই অনুমেয়। তবে প্রথম থেকেই যদি এ ধরনের বিষয়কে চুক্তি বহির্ভূত হিসাবে ধরে নিয়ে সমাজের প্রচলন হিসেবে এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, প্রথমে তাদের উদ্দেশ্য ছিল তারা উৎপাদিত মূল ফসলের চুক্তি করেছে আর উৎপাদিত অতিরিক্ত ফসলের বেলায় জমিটি ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে, এরূপ হলে তা জায়েয হতে পারে, তবে এক্ষেত্রে জায়েয হওয়ার জন্য উভয়ের সম্মতি অত্যাবশ্যক ।
কিছু জমির মালিক এমন প্রকৃতির হয়ে থাকে যে, নিজের অংশ ব্যতীত বর্গাদারের অংশ হতে স্বীয় চাকর বাকর এবং দুষ্ট প্রকৃতির লোকদের অংশ আদায় করে থাকে । ঐ অংশটি যদি এক মন কিংবা দুই মন এভাবে নির্ধারণ করে থাকে তাহলে তা জায়েয হবে না। পক্ষান্তরে যদি তা হার হিসাবে নির্ধারণ করা হয় তাহলে জায়েয হবে। যেমন মন প্রতি এক সের পরিমাণ চাকরের জন্য ।
কিছু লোক এমন আছে যে, যমীনে কি ফসল ফলানো হবে সে সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলে না। অতঃপর এ বিষয়কে কেন্দ্র করে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। এরূপ করা না জায়েয, নিয়ম হলো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে হবে নতুবা সাধারণ অনুমতি থাকবে যে বর্গাদার যা চায় তাই ফলাবে।
অনেক এলাকায় এরূপ প্রচলন আছে যে বর্গাদার বীজ রোপণ করে অন্যকে হাওলা করে দিয়ে বলে “তুমি এর চাষ কর" উৎপাদিত শষ্য থেকে এক-তৃতীয়াংশ তোমাকে দেয়া হবে, এটিও এক ধরণের বর্গাচুক্তি। যদি মূল মালিক এ ব্যাপারে বাধা দেয় তাহলে এটি নাজায়েয হবে । আর বাধা না দিলে তা জায়েজ হবে।
উপরের মাসআলাটির বিশ্লেষণ প্রায় চাকরকে দেয়ার মাসআলার মত । এখানে কিছু ফসল কৃষকদের বন্টন করে দেয়া হয় আর কিছু ফসল বিঘা প্রতি কর দেয়া হয় ফলে এতেও নাজায়েয হওয়ার কারণ বিদ্যমান এবং জায়েয হওয়ার পুর্বোক্ত ব্যাখ্যা এখানেও প্রজোয্য ।
১২ বছর এক জমি চাষ করলে জমির মালিক হওয়া বিধান ষ
ভাড়া এবং বর্গাচাষের ভিত্তিতে একাধারে বার বৎসর অথবা তার কম বা বেশী ভোগ দখল সূত্রে থাকায় কোন জমির উত্তরাধিকারীত্ব দাবী করা সম্পূর্ণভাবে বাতিল, অন্যায় হারাম, এবং জবর দস্তি মূলক কাজ মূল মালিকের পূর্ণ সম্মতি ব্যতীত যমীন ভোগ দখল না জায়েয । এ প্রকার জমির উৎপাদিত ফসল সবকিছুই হারাম এবং অবৈধ বলে গণ্য হবে ।
মুসাকাত বা ফলের বর্গা চাষ সর্বাবস্থায় মুযারাআত বা জমির বর্গার ন্যায় হবে।
মুসাকাত বা ফলের উপর কৃত বর্গাচুক্তি রহিত হয়ে গেলে গাছের মালিক ফলের মালিক হবে। আর পরিচর্যাকারী তার পারিশ্রমিক পাবে, যেমনটি পূর্বে জমি বর্গার ক্ষেত্রে আলোচনা করা হয়েছে ।
তথ্য সূত্র:
- হেদায়া খন্ড ৪ পৃঃ ৪০০,
- দুররুল মুখতার খন্ড ২ পৃঃ ২২৩
- দুররুল মুখতার খন্ড ২ পৃঃ ২২৩
- হেদায়া খন্ড ৪ পৃঃ ৪১
- শামী খন্ড ৫ পৃঃ ১৯৭
- ফাতাওয়া হিন্দিয়া খন্ড ৬ পৃঃ ১৫৮
উপসংহার
প্রিয় বন্ধু যদি আপনি হালালভাবে জমি বর্গা নিয়ে চাষ করতে চান তাহলে উপরে বর্ণিত নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে তাহলেই সম্পূর্ণ জায়েজ এবং হালাল পদ্ধতিতে ফসল ফলিয়ে জীবন যাপন করতে পারবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে হালাল ভাবে জীবিকা অর্জন করার তৌফিক দান করুক।