আশুরার দিন নিয়ে বহু ভ্রান্ত আকিদা ও বিশ্বাস সমাজে বিরাজমান রয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখন আমরা কুরআন হাদিসের আলোকে কিছু ভ্রান্ত আকিদা ও বিশ্বাসের যাচাই-বাছাই করব।
somadanmedia.com |
শিয়া সম্প্রদায়ের লোকদের যদি আপনি জিজ্ঞেস করেন 'আশুরা কি?' তারা উত্তরে বলবে এ দিনে আমাদের মহান ইমাম হুসাইন আ. কারবালাতে যুদ্ধ করে শহীদ হয়েছেন। তাই এ দিনটি পবিত্র।
যদি অন্য জ্ঞানী ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেন 'আশুরার তাৎপর্য কি?' তখন তিনি এর সাথে এমন কিছু কথা বলবেন যার সমর্থনে কুরআন বা সহীহ হাদীসের কোন প্রমাণ নেই। তাদের বক্তব্য শুনে মনে হবে বিশ্বের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আল্লাহ রাববুল আলামীন এ আশুরাতে ঘটিয়েছেন ও আগত ভবিষ্যতের সকল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও আশুরাতে সংঘটিত করাবেন। পৃথিবীর সৃষ্টি ও ধংশ সবই নাকি এ দিনে হয়েছে ও হবে বলা হয়ে থাকে এ দিনে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছে।
আদম আ. এর সৃষ্টি এ দিনে হয়েছে। আদম আ. কে এ দিনে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হয়েছে। এ দিনে আদম ও হাওয়ার মিলন হয়েছিল আরাফাতের ময়দানে। উভয়ের তাওবা কবুল হয়েছিল এ দিনে। নূহ আ. এর প্লাবন এ দিনে হয়েছিল। প্লাবন শেষে নূহ আ. এর নৌকা এ দিনে জুদী পাহাড়ে ঠেকে গিয়েছিল। আইউব আ. এর দীর্ঘ রোগমুক্তি এ দিনে হয়েছিল। মাছের পেট থেকে ইউনুছ আ. এর মুক্তি লাভ এ দিনে হয়েছিল। মুছা আ. তাওরাত লাভের জন্য তুর পাহাড়ে এ দিনে গমন করেছিলেন। নমরুদের আগুন থেকে ইব্রাহীম আ. এ দিনে মুক্তি পেয়েছিলেন। ইয়াকুব আ. এ দিনে দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন সুলাইমান আ. এ দিনে তার হারানো রাজত্ব ফিরে পেয়েছিলেন। ইসা আ. এর জন্ম এ দিনে হয়েছিল।
ইসা আ. কে এ দিনে আসমানে উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল। এ দিনে কাবা শরীফের নির্মান কাজ সম্পন্ন হয়েছিল। এ দিনে কিয়ামত সংঘটিত হবে আরো কত কিছু যে এ দিনে ঘটেছিল তা আপনি যেমন মসজিদের মিম্বরে উপবিষ্ট অনেক ইমাম সাহেবের মুখে শুনতে পাবেন। তেমনি শুনতে পাবেন এ দিন সম্পর্কে যারা রেডিও, টিভিতে বক্তব্য রাখেন তাদের মুখে।
যদি সম্ভব হত তাহলে তারা বলতেন "সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জন্ম ও মিরাজ আসলে এ দিনেই হয়েছিল।" আমরা যতদূর খোঁজ-খবর নিয়েছি তাতে উপরোক্ত তথাগুলোর সত্যতার সঠিক ও বিশুদ্ধ কোন প্রমাণ পাইনি। না আল-কুরআনে না রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীসে আছে আমরা যারা দ্বীন প্রচারে ভূমিকা রাখি, মসজিদের ইমাম-খতীব, ওয়ায়েজীনে কেরাম, দাওয়াত কর্মী তারা কি পারি না এ সংকল্প নিতে যে, আমরা দ্বীন সম্পর্কে যা কিছু বলব তা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বলব। যা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয় তা আমরা বলবো না। আবার যা আল্লাহ ও তার রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন আমরা তার থেকে কিছু বাড়িয়ে বলব না।
আমরা কি জানিনা আল্লাহ তায়ালা দ্বীন সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন। এবং তার রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার উম্মতকে সর্বদা সতর্ক করে বলেছেন।
أيها الناس ! إياكم والغلو في الدين، فإن أهلك من كان قبلكم الغلو في الدين، رواه ابن ماجه وصححه الألباني
হে মানব সকল। সাবধান তোমরা দ্বীনের মধ্যে বাড়াবাড়ি করবেনা। তোমাদের পূর্ববর্তীরা দ্বীনে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংশ হয়ে গেছে।( ইবনে মাজাহ)
অনেকে বর্ণিত হাদীসে 'আল-গুলু' বা 'বাড়াবাড়ি' শব্দের অর্থ মনে করেন 'জবরদস্তি। এটা ঠিক নয়। 'জবরদস্তি'র আরবী হল 'ইকরাহ'। ধর্মে বাড়াবাড়ি করা মানে ধর্মে যা নেই তা ধর্ম হিসেবে পালন করা বা ধর্মের বিধান পালনে সীমা লংঘন করা। অথবা ধর্মীয় আমলের সাথে কিছু সংযোজন করা। ইহুদী খৃষ্টানেরা এ রকম বাড়াবাড়ি করেই নিজেদের ধর্মকে ধ্বংশ করেছে।
আল্লাহ এবং তাঁর রসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবায়ে কেরাম আশুরার ফজীলতের ব্যাপারে যা বলেননি আমরা তা কেন বলব? যদি আমরা এমনটি করি তাহলে শিয়া ও রাফেজীগন যে বাড়াবাড়ি করেন তার প্রতিবাদ করার আদর্শিক ও নৈতিক অধিকার আমাদের কিভাবে থাকে?
সম্মানিত পাঠক!
এ দিনের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই। এ দিনকে খাটো করাতে আমাদের কোন লাভ নেই। ইতিহাসের সকল ঘটনা এ যদি দিনে ঘটে থাকে তাতে আমাদের ক্ষতি কি?
কিন্তু আমাদের কথা হল আশুরা সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক হতে হবে। যা কুরআন ও সহীহ হাদীসে নেই তা ইসলামের নামে প্রচার করা যাবে না। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হবে। আর বর্ণিত তথ্যগুলো এমন বিষয় যা আকীদাহর সাথে সম্পর্কিত তাই ইজমা বা কিয়াস দ্বারা প্রমাণ করা যায় না। তাই আমি অনুরোধ করবো যারা আশুরা সম্পর্কে মানুষদের জ্ঞান দিবেন তারা যেন সনদ-সূত্র ও দলীল-প্রমাণ বিহীন এ সকল অতিরিক্ত কথাগুলো পরিহার করে চলেন।
আশুরার দিন ভাল খাবার দাবারের আয়োজন করা সম্পর্কে একটি হাদীস দেখা যায়। তাহলঃ
من وسع على عياله يوم عاشوراء وسع الله عليه سائر السنة. قال الإمام أحمد : لا يصح هذا الحديث
যে ব্যক্তি আশুরার দিনে তার পরিবারবর্গের লোকদের জন্য সচ্ছলতার (ভাল খাবার) ব্যবস্থ করবে আল্লাহ সারা বছর তাকে সচ্ছল রাখবেন।" ইমাম আহমদ বিন হাম্বল (রহঃ) বলেছেনঃ হাদীসটি সহীহ নয়।
এ হাদীস মুতাবিক আমল করা যাবেনা কয়েকটি কারণেঃ
(১) হাদীসটির সকল সূত্র দুর্বল যেমন প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ইবনে কায়্যিম জাওযী (রহঃ) এ হাদীস সম্পর্কে বলেছেনঃ
رواه الطبراني عن أنس مرفوعا، وفي إسناده الهيصم بن شداخ وهو مجهول، ورواه العقيلي عن أبي هريرة وقال: سليمان بن أبي عبد الله مجهول، والحديث غير محفوظ، وكل طرقه واهية ضعيفة لا تثبت
তাবারানী হাদীসটি আনাস রা. সূত্রে বর্ণনা করেছেন। এ সূত্রে হাইছাম ইবনে শাদ্দাখ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। এবং উকায়লী বর্ণনা করেছেন আবু হুরাইরা রা. থেকে। এবং তিনি বলেছেনঃ এ সূত্রে সুলাইমান বিন আবি আব্দুল্লাহ নামের ব্যক্তি অপরিচিত। হাদীসটি সংরক্ষিত নয় আর এ হাদীসের প্রত্যেকটি সূত্র একেবারে বাজে ও খুবই দুর্বল।(আল-মানারুল মুনীফ ফিসসহীহ ওয়াজ যয়ীফ। ইবনে কায়্যিম জাওযী-রহঃ)
(২) এ হাদীসটি রসূলে কারীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সেই সকল সহীহ হাদীসের বিরোধী যাতে তিনি আশুরাতে সওম পালন করতে বলেছেন। সওম পালন করলে সে দিন কিভাবে ভাল খাবার আয়োজনের প্রশ্ন আসতে পারে? এ বিষয়টির বিবেচনায় হাদীসটি মুনকার।
বলা যেতে পারে যে, দিনের বেলা সত্তম পালন করে তারপর রাতে ভাল খাবারের ব্যবস্থা করলে উভয় হাদীস মোতাবেক আমল করা যায়।
না, তা হতে পারেনা। কারণ ইতিপূর্বে আলোচিত সাহাবী আবু মূসা রা, বর্ণিত বুখারী মুসলিমের হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, খায়বরের ইহুদীরা এ দিনে আনন্দ-উৎসব ও সচ্ছলতা প্রদর্শন করত। রসুলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর বিরোধীতা করে সওম পালন করতে বলেছেন। অর্থাৎ সচ্ছলতা প্রদর্শন (ভাল খাবার ও পোষাক ব্যবহার) করা যাবে না। বরং এর বিরোধীতা করে সওম পালন করতে বলা হয়েছে। যদি এ দিনে ভাল খাবার-দাবারের আয়োজন করা হয় তবে তা ইহুদীদের সাথে সাদৃশ্য আচরণ বলে গণ্য হবে।
(৩) অনেকে বলে থাকেন যে, আগুরাতে ভাল খাবার-দাবার সম্পর্কিত হাদীসটি একটি ফজীলতের হাদীস। তাই তার সনদ দুর্বল হলেও আমল করতে অসুবিধা নেই।
আসলে 'ফজীলত সম্পর্কিত হাদীস দুর্বল হলেও সর্বক্ষেত্রে তা আমল করা যায় বা
হাদীসটি গ্রহণ করা যায়' এমন ধারণা ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ তার অনুরূপ সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তখন দুর্বল হাদীস তার সনদের দুর্বলতা কাটিয়ে 'হাসান' এর স্তরে পৌছে যেতে পারে। তখনই সে হাদীস মুতাবিক আমল করা বা হাদীসটি গ্রহণ করার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কোন প্রমাণিত আমলের ফযীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল সূত্রের হাদীস গ্রহণ করা যায়। এর অর্থ এ নয় যে কোন আমল প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দূর্বল হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু আলোচ্য হাদীসটির বিষয় বস্তুর সমর্থনে কোন সহীহ হাদীস পাওয়া যায় না।
'আমলের ফজীলতের ক্ষেত্রে দুর্বল হাদীস গ্রহণযোগ্য' এ নীতি সম্পর্কে কথা হল যে সকল আমল ও তার ফজীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়ে গেছে সে সকল আমলের ফর্জীলতের ক্ষেত্রে যয়ীফ (দুর্বল) হাদীস গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু যে আমলটি কুরআর বা সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিতই হয়নি তার ফজীলত কি ভাবে দুর্বল হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা যায়? এটা করলে তো দুর্বল হাদীস দ্বারা শরয়ী ভাবে অপ্রমাণিত একটি আমল প্রমান করা লাযেম (অপরিহার্য) হয়ে যায়।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, কুরবানী করা ও তার ফজীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। একটি দুর্বল হাদীস পাওয়া গেল যাতে বলা হয়েছে' কুরবানীর পশুর প্রতিটি লোমের পরিবর্তে সওয়াব পাওয়া যাবে এ হাদীসটির সস্পদ দুর্বল হলেও গ্রহণ করা যায় একারণে যে উল্লেখিত আমল ও তার ফজীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত।
কিন্তু আশুরাতে 'ভাল খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করা' সম্পর্কিত আমলটি সহীহ সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়নি। ফলে এ হাদীসটি আমল করতে গেলে দুর্বল হাদীস দ্বারা আমল প্রমাণিত হয়ে যায়, শুধু ফজীলত নয়। অপরদিকে এ হাদীসটি বুখারী মুসলিম বর্ণিত সহীহ হাদীসের খেলাফ। সে হিসেবে হাদীসটি মুনকার বা গ্রহণযোগ্য।
(৪) আলোচ্য হাদীসটি যে শুধু মাত্র আমলের ফজীলতের কথা বলে তা নয়। এ হাদীসটি আকীদাহর সাথেও সম্পর্কিত। আর তা হল আশুরাতে আনন্দ-উৎসব করার আকীদাহ ও এর ফলে সাড়া বছর ভাল অবস্থায় থাকার ধারণা। অতএব আকীদাহর ক্ষেত্রে কোন দুর্বল সূত্রের হাদীস গ্রহণ করার কোন অবকাশ নেই।
পরিশেষে
এ কথা বলি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে আমল করার ক্ষেত্রে সকল ধরনের বাড়াবাড়ি এবং ছাড়াছাড়ি থেকে মুক্ত করে মাধ্যম পন্থা অবলম্বন করার তৌফিক দান করুন আমীন।