মালিক ইবনু দীনার (মৃত্যু 748 খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন পার্সিয়ান পণ্ডিত এবং ভ্রমণকারী। তিনি রাজা চেরামান পেরুমালের বিদায়ের পরে ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে ভারতে আগত প্রথম পরিচিত মুসলমানদের মধ্যে একজন ছিলেন। তিনি প্রথমেই আল্লাহ তায়ালার প্রিয় বান্দা ছিলেন না তিনি কিভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রিয় বান্দা হলেন আজ সে ঘটনায় আপনাদেরকে শোনাবো।
মালিক ইবনু দিনার রহঃ কি কাজ করে আল্লাহর বন্ধু হলেন।
এক দুঃস্বপ্ন ইসলামের মহান মনিষী মালিক ইবনু দিনারকে তাওবার কাছে নিয়ে আসে, তার জীবন বদলে দেয়। মালিক ইবনু দিনার রহিমাহুল্লাহকে তার ফিরে আসার কথা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন,
আমি ছিলাম পুলিশের লোক এবং মদ্যপায়ী। আমার এক দাসী ছিল, যে আমার সাথে খুব ভালো আচরণ করতো। তার গর্ভে আমার এক মেয়ের জন্ম হয়, মেয়ের প্রতি ছিল আমার তীব্র অনুরাগ। যখন সে হাঁটতে শিখলো তখন তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা আরো বেড়ে যায়। আমি মদ খেতে গেলে সে এসে মদের গ্লাস ধরে টান দিত, এতে সব আমার কাপড়ের উপর গড়িয়ে পড়ত। যখন তার বয়স দুই বছর, তখন সে মারা যায়। আমি অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়েছিলাম।
ঐ বছরের ১৫ই শা'বানের দিন ছিল শুক্রবার। আমি মাতাল অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়লাম, জুমার সালাতও পড়িনি। ঘুমে আমি স্বপ্নে দেখলাম কিয়ামত এসে গেছে, শিংগায় ফুঁ দেয়া হয়েছে, কবরগুলোর পুনরুত্থান ঘটেছে। আরো দেখলাম মানুষদের একত্রিত করা হলো। আমিও ছিলাম তাদের মাঝে। পিছন থেকে আমি হিস হিস শব্দ শুনতে পেলাম। পিছনে ঘুরে দেখি একটি নীল-কালো রঙের বিশাল সাপ আমার দিকে তেড়ে আসছে। আমি ভয়ে আতংকে প্রাণপণে দৌড়াতে লাগলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে আমি একজন বুড়ো মানুষকে দেখতে পেলাম। তার পরনে ছিল সুন্দর পোশাক, গায়ে সুগন্ধি। আমি তাকে সালাম দিয়ে সাহায্য চাইলাম। এতে তিনি কেঁদে ফেলেন, এবং বললেন, তিনি অনেক দুর্বল, আর সাপটি তার চাইতে অনেক বেশী শক্তিশালী। তিনি আমাকে দৌড়াতে থাকতে বললেন, এই আশায় হয়তো সামনে এমন কাউকে পাব যে আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আমি দৌড়াচ্ছিলাম, একটা উঁচু জায়গায় পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ করে দেখি আমি আগুনের উপত্যকার শীর্ষে বসে আছি। আগুন দেখে এতটা ভয় হচ্ছিল যে, মনে হলো আমি এই তো আগুনে পড়েই যাচ্ছি। তখন আমি একজনের আওয়াজ শুনতে পাই। কেউ চিৎকার করে বলছিল, "এখান থেকে চলে যাও, এটা তোমার স্থান নয়,” চিৎকার শুনে আমি কিছুটা সাহস ফিরে পাই। আমি দৌড়ানো বন্ধ না করে আরো দৌড়াতে লাগলাম। সাপটি তখন আমার পায়ের গোড়ালির সাথে ছিল। আমি সেই বুড়োকে আবার দেখতে পাই, তাকে আবার আমি সাহায্য করতে বলি। তিনি আগের মত করে কান্না করে বলেন, তিনি দুর্বল, সাপ তার চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী, তিনি কোনো সাহায্য করতে পারবেন না।
এরপর তিনি আমাকে একটি পাহাড় দেখিয়ে দিয়ে বলেন, আমি সেখানে হয়তো নিজের জমানো এমন কিছু পাবো, যা আমাকে সাহায্য করতে পারবে। আমি পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এটি ছিল বৃত্তাকার এবং পুরো পাহাড়টি তৈরি ছিল রূপা দিয়ে। পাহাড়ে ছিল অনেকগুলো ছিদ্র করা জানালা ও তাতে ঝুলছিল পর্দা। প্রতিটি জানালায় ছিল দুইটা সোনার কপাট। প্রতিটা কপাটে ছিল রেশমী পর্দা। আমি দ্রুত সেই পাহাড়ের দিকে দৌড়ে গেলাম। একজন ফেরেশতা বলে উঠলেন, "পর্দা উঠাও। কপাট খুলে দেখো। হয়তো এখানে এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষটির কোন সঞ্চয় আছে, যা তাকে সাহায্য করবে।" আমি তখন অনেকগুলো ছোট শিশুকে দেখতে পেলাম, যাদের চেহারা জানালার ফাঁক দিয়ে ছোট চাঁদের মত উকি দিচ্ছে। তখন তাদের একজন বলে উঠল, 'তোমাদের কি হলো? জলদি আসো, তাঁর শত্রু তাঁকে প্রায় ধরে ফেলেছে।'
তারা এগিয়ে এলো এবং তাদের জানালার ফাঁক দিয়ে উকি দিয়ে তাকালো। তাঁরা সংখ্যায় শত শত। আমি তখন আমার মৃত মেয়েটির চেহারা দেখতে পেলাম। সেও আমাকে দেখতে পেল, দেখতে পেয়ে সে কান্না করল। এবং বলল, "আল্লাহর কসম! তিনি আমার বাবা," এরপর সে জানালা দিয়ে এত দ্রুত বেরিয়ে নূরের পুকুরে লাফ দিল, ঠিক যেন ধনুক থেকে বের হওয়া তীর। তারপর সে আমার সামনে এলো, এবং আমার দিকে তাঁর হাত বাড়ালো। আমি তাঁর হাত আঁকড়ে ধরে ঝুলেরইলাম। সে তাঁর আরেকটি হাত দিয়ে সাপটিকে তাড়িয়ে দিল। এরপর সে আমাকে বসালো। আমার কোলের উপর বসে আমার দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো, 'আব্বা! যারা মুমিন তাদের জন্য কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবতীর্ণ হয়েছে তার কারণে হৃদয় বিগলিত হবার সময় আসেনি?
আমি কাঁদতে শুরু করলাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম সে কোথা থেকে কুরআন শিখলো। সে বললো এখানকার শিশুরা পৃথিবীতে যা জানতো তাঁর চাইতে বেশী জানে। আমি তখন আমার পিছনে আসা সাপ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সে জানালো, সেটি হলো আমার খারাপ আমল, যা আমাকে দোযখে নিয়ে যেত। আমি তখন সেই বুড়ো লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। আমার মেয়ে বললো, সে হলো আমার ভালো আমল, যা এত দুর্বল যে আমাকে সাপটি থেকে রক্ষা করতে পারলো না। আমি এরপর জানতে চাইলাম, তাঁরা (শিশুরা) পাহাড়ের ভিতরে কি করছে? সে জানালো, এরা সবাই হলো মুসলিমদের মৃত সন্তান। এরা তাদের বাবা-মায়ের সাথে দেখা হবার জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁরা কিয়ামতের দিন তাদের বাবা মায়ের জন্য শাফায়াত করবে। মালিক ইবনু দিনার বলেন, আমি আতংকে ঘুম থেকে জেগে উঠলাম। আমি আমার মদের সব বোতল ভেঙ্গে ফেললাম, আর আল্লাহর কাছে তাওবা করলাম। এই হচ্ছে আমার তাওবার কাহিনী।
সূত্রঃ
মুয়াফিক মুশরিকাহ ফি হায়াতিস সালাফ-৪৯
উক্ত ঘটনা থেকে আমাদের উপদেশ
প্রিয় ভাই ও বোনেরা আমার আমরা দুনিয়াতে চিরকাল থাকবো না আমাদের চলে যেতে হবে করবে তার পর হাসরে অতঃপর জান্নাত কিংবা জাহান্নামে। যদি দুনিয়াতে মহান রবের হুকুম পালন করতে পারি তাহলে আশা করা যায় যে আল্লাহর রহমতে জান্নাতে যেতে পারবো। জান্নাতে যেতে পারলেই আমরা সফলকাম। আন্যথায় চির ব্যার্থ। তাহলে চলুন আমরা মালিক ইবনু দিনারের হায়াত থাকতে তাওবা করে আল্লাহর কাছে ফিরে আসি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুক।